বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাতর পুরুলিয়ার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে ঝুমুর গান নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় সোহম দাস।

সাক্ষাৎকারে সুনীল মাহাত: ঝুমুর গানের সেকাল তার ভাব, ভাষা ও ইতিহাস

in Interview
Published on:

সোহম দাস (Soham Das)

সোহম দাস আমেরিকান কলেজ-পড়ুয়াদের সাহায্যকারী একটি সংস্থা চেগ আইএনসির ওয়েবসাইটে ভূবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কলা-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে তাঁর বরাবরের আগ্রহ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও ওয়েব ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত নিবন্ধ ও ফিচার লিখে থাকেন। প্রধানত খেলা, ইতিহাস, সিনেমা তাঁর লেখার অন্যতম বিষয়। এছাড়া, বিলগ্ন সাংবাদিক ও অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অনলাইন নলেজ প্ল্যাটফর্ম 'রোর মিডিয়া'র বাংলা বিভাগ 'রোর বাংলা'য় একসময় নিয়মিত লিখতেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই 'তেকাঠি ও তারা খসার গল্প'। তাঁর লেখার ক্ষেত্র মূলত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। কলকাতা দূরদর্শনে তথ্যচিত্র ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখার কাজে যুক্ত আছেন। লেখার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনাও করেন।

বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাতর পুরুলিয়ার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে ঝুমুর গান নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় সোহম দাস।

সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে যাঁর সংস্কৃতি এবং দর্শন কেটেছে এই লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে, সেই মানুষটির সাহচর্যে জেনে নেওয়া গিয়েছিল তাঁর যাত্রাপথের অলি গলি—তাঁর অনুভব, জীবনবোধ এবং শিক্ষানুভূতি।

সোহম দাস: আপনারা যখন শুরু করেছিলেন ঝুমুর নিয়ে এই গবেষণা, তখন ঝুমুরকে কী চোখে দেখা হত, এবং সেই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে আপনারা কাটিয়ে উঠে   কী কী পদক্ষেপ নিয়ে ঝুমুরের একটা পুনর্জন্ম ঘটালেন?

সুনীল মাহাত: পদক্ষেপ বলতে, এই যে গবেষণা বললেন, আমি ঠিক ওই অর্থোডক্স রিসার্চটা করিনি। আমার গবেষণার ধরনটা হল একটু ক্রিয়েটিভ রিসার্চ। মানে, নতুন করে জিনিসটাকে পুনর্গঠন করা। আমি আধুনিক গান গাইতাম, লিখতাম। তারপর এখানকার যাঁরা লোকসংস্কৃতিবিদ ছিলেন, যেমন  ডঃ পশুপতিপ্রসাদ মাহাতর বাবা, রবীন্দ্রনাথ মাহাত, এঁদের সংস্পর্শে যখন আসি, তখন ওঁরা আমাকে সাজেস্ট করেন যে, তুমি ঝুমুরের উপর কিছু কাজ করো। পশুপতিদার বাবা আমাকে একদিন নিয়ে গেলেন একটা অনুষ্ঠানে। ‘ ওখানে, আমাদের এখানকার একজন বিখ্যাত গায়ক ছিলেন। খুব নামকরা লোক, মিহিরলাল সিংদেও, যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালন পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তখন ওঁর কম বয়স ছিল,  একটু প্রৌঢ়ের দিকে। তাঁর গলায় ঝুমুর শুনে তো আমি তো মুগ্ধ হয়ে ভাবছি যে, ঝুমুরও এত ভাল হতে পারে! তখন ভাবলাম, সেটাকে যদি আরও ভালভাবে রূপ দেওয়া যায় , তাহলে একটা এক্সেলেন্ট জিনিস হতে পারে। তাঁর গলা থেকে ঝুমুর শুনে ঝুমুরের সম্বন্ধে আমার একটা আলাদা ধারণা তৈরি হয়ে গেল। তার আগে আমরা যে ঝুমুরগুলো শুনতাম, গ্রামের মাঠে-ঘাটে, সেগুলো ঠিক পরিশীলিত বলা যায় না। এমনিতে মাঠে-ঘাটে যারা গানটা ন্যাচারালি গায়, তারা তো প্রফেশনাল গায়ক-গায়িকা নয়। তাদের গাওয়া গানগুলো ঠিক কানে লাগার মতো ছিল না।  এরপর ঝুমুর নিয়ে বিভিন্ন কাজ করার মাধ্যমে ঝুমুরের মধ্যে ঢুকে যাই।  গ্রামে  কিছু ঝুমুর নাচের দল ছিল। কম ছিল, কিন্তু ছিল। বিভিন্ন গ্রামে আমি তাদের অনুষ্ঠান আয়োজন করতাম। যেমন, আমার গ্রামে এবং পাশের গ্রাম রামকৃষ্ণপুরে ঝুমুর নাচের প্রতিযোগিতা হত। সেইসব প্রতিযোগিতায় আমি অনেক সময়েই জাজ হিসেবে থাকতাম। ঝুমুরের সুরটা কত রকমের হতে পারে, আমি সেগুলো দেখতে শুরু করলাম। তখন কিছু কিছু নাচনি নাচের শো হতো। নাচনিরা নাচত বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে। দেখলাম যে, তার মধ্যে ঝুমুরের অনেক ভ্যারাইটি আছে। ধীরে ধীরে যখন আমি ঝুমুরের মধ্যে প্রবেশ করছি, তখন আমি দেখছি, যে, প্রাচীনকালে এক ধরনের ঝুমুর ছিল। সেটা ছিল মানুষের জীবন-জীবিকার উপর। তারপর মাঝখানে, চৈতন্য মহাপ্রভুর আগমন। তখন এখানে বৈষ্ণব ধর্ম খুব ভালভাবে প্রচারিত হল। গ্রামে গ্রামে হরিমেলা তৈরি হল, হরিনাম সংকীর্তনের দল হল। এইসময়, এখানকার মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। ওই যে বৈষ্ণব ধর্মটার প্রচার হল, তার ফলে এখানে নতুন ধরনের একটা ঝুমুরের সৃষ্টি হল। এই সময় আমাদের  বিখ্যাত সব কবি এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী শিল্পীরা ঝুমুরে অংশগ্রহণ করলেন। তাঁদের মধ্যে রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি, ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, দীনা তাঁতি, বরজুরাম দাস, জগৎ কবিরাজ, বিনন্দিয়া সিং, এরকম অনেক নাম আছে যাঁরা ঝুমুরের উপর খুব ভাল কাজ করেছেন।  তাঁদের কম্পোজিশনগুলো খুব উন্নত মানের; সেগুলোকে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। যদিও এটার উপরে বাংলা সাহিত্য ততটা আলোকপাত করেনি। এই সময় ঝুমুরে একটা বিপ্লব হয়ে যায়। নানা ধরনের এলিমেন্ট তখন ঝুমুরে আসে। প্রথম দিকে ওটা জীবন-জীবিকার গান ছিল। এই সময়ে ঝুমুরে আসে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বিরহ, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, সুফি  চিন্তাভাবনা। দেহতত্ত্ববাদও কিন্তু ওই সময়েই ঝুমুরে আসে। যখন রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলিরা বা ভবপ্রীতানন্দ ওঝারা ছিলেন, তখন কিন্তু এখানকার রাজা বা জমিদার যাঁরা ছিলেন, যেমন কাশীপুরের জমিদার, ইছাগড়ের রাজা, বাঘমুণ্ডির রাজা, জয়পুরের রাজা, সিলির রাজা, এঁরা কিন্তু ঝুমুরকেএবং তার  নাচনিদের প্রচুর সাপোর্ট করেছেন। রাজদরবারে ঝুমুর গান হত এবং ঝুমুরের চর্চাটা হত। এই সময়ে যে ঝুমুর সৃষ্টি হল, তাকে আমরা দরবারি ঝুমুর বা নাচনিশালিয়া ঝুমুর বলি। এই সময়ে বাজনারও পরিবর্তন হল। আগে যেরকম আমরা ঢোল, নাগাড়া (বা ধামসা), ঢাক, এসব নিয়ে ঝুমুর গান হতে দেখেছি, সেখানে পরবর্তীকালে কর্নেট এল।  হারমোনিয়াম এল, তারপর তবলা এল এবং তার সঙ্গে   ইন্সট্রুমেন্টালেও নানা পরিবর্তন হল। এই সময়টা ঠিকই ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন রাজন্যভাতার বিলোপ হল, তখন ঝুমুরকে মদত দেওয়ার আর কেউ থাকল না। ঝুমুরের শ্রোতা হল সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী অনেক গান রচিত হল এবং সেগুলো কিছু নিচুস্তরের যৌন-উত্তেজক  গান  হল। ঝুমুরকে সেই সময়টায় বলা হতে লাগল, ‘মাতালদের গান’। বলা হল, যারা মুনিশ, কামিন, বাগাল, মানে যারা শিক্ষিত লোক নয়, এটা তাদের গান। সেই সময়টাতে ঝুমুর ভীষণ নিন্দিত হতে থাকল। যারা শিক্ষিত সম্প্রদায়, তারা ঝুমুর সম্পর্কে বলত যে, না, না, ওইসব গান চলবে না। কলকাতারও কিছু পণ্ডিত-শিল্পী ঝুমুরকে ‘যৌনগন্ধী’ গান বলে আখ্যায়িত করল। এটা ঠিক ভদ্র সমাজে চলে না, এরকম একটা গান। আমরা যখন ঝুমুর নিয়ে চর্চা শুরু করলাম, তখন কিন্তু বাড়ির লোকরা আমাদের বাধা দিত। বাবা এসে বলতেন যে, না, না, বাড়িতে এসব ঝুমুর গান নয়, ওসব বাইরে। আমার মনে তখন একটা কথা স্ট্রাইক করে যে, না, ঝুমুরের এত সুন্দর সুন্দর সুর আছে, এত সুন্দর সুন্দর কথা আছে, তার মধ্যে কিছু কথা হয়তো একটু উল্টোপাল্টা আছে, কিন্তু এটাকে যদি আমরা ঠিকঠাক পরিবেশন করতে পারি, এটাকে যদি আমরা সুর দিয়ে,  কথা বসিয়ে নতুনভাবে বানাতে পারি, যদি আমরা নতুন নতুন বিষয়ের  আমদানি করে লোকসঙ্গীতের মধ্যে যে চেতনা বিকাশের জায়গা আছে, সেই কাজটা ঝুমুরের মাধ্যমে করতে পারি, তাহলে ঝুমুর কেন অ্যাক্সেপ্টেড হবে না! সেখানে নতুন সুরের এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে। সেই কাজটাই আমি মূলত করেছিলাম। ফোক মিডিয়ার উপরেও আমি সেই সময় একটা রিসার্চ করেছিলাম। এটা লন্ডনের একটা সংস্থা, ডব্লিউএসিসি (ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্রিশ্চান কমিউনিকেশন) থেকে সাতটা দেশজুড়ে করা হয়েছিল। তার মধ্যে ভারতের হয়ে গবেষণা এবং ফিল্ডওয়ার্ক আমিই করেছিলাম। তখন তো মিডিয়ার এত ছড়াছড়ি ছিল না, কাগজপত্রগুলোও গ্রামের দিকটা ঠিকঠাক কভার করতে পারত না। টিভি বলতে শুধু ডিডি ওয়ান। তখন এটা আলোচনায় আসে যে, আমাদের এই নতুন ধরনের কাজের খবরগুলো, সাম্প্রতিক খবরগুলো কীভাবে আমরা পাবলিকের মধ্যে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে আমরা ফোক মিডিয়া হিসেবে ফোকটাকে ব্যবহার করতে পারি, মানুষের চেতনার উন্মেষের জন্যে। আমি দেখলাম এই গানের মধ্যে যদি আমরা নতুন নতুন কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সগুলোকে দিতে পারি, তাহলে সেটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এই যে অবহেলিত পুরুলিয়া বা জঙ্গলমহল এলাকার মানুষদের যে অভাব-অভিযোগ, বা এখানকার যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলোকে যদি আমরা ঝুমুর গানের মধ্যে তুলে ধরতে পারি, সেটায় ডেভেলপমেন্টেরও কাজ হবে, আবার ঝুমুর গানকে নতুন করে তুলে ধরারও কাজ হবে। এখানকার ঝুমুর গান, বা টুসু গান, বা করম গান, এগুলোকে যদি আমরা ব্যবহার করতে পারি, সেই ভেবে আমি  নতুন করে কিছু কিছু কম্পোজিশন করা শুরু করলাম। তার মধ্যে একটা কম্পোজিশন ছিল ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন’। প্রথম একটা গান আমি তৈরি করলাম এখানে, ফোকের কিছু লাইন নিয়ে, আর নিজে কিছু কিছু অ্যাড করে। তখনও আমি ঝুমুরটা অতটা আয়ত্ত করতে পারিনি। দেখা গেল যে, ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন’ খুব জনপ্রিয় হল।  গোটা পৃথিবীতেই বাঙালিরা এখন যেখানে যেখানে আছে, এই গানটা গাইছে। এরকম অনেক গান আছে আমার, যেগুলো খুব পপুলার হয়েছে। নতুন নতুন জিনিস এখানে আমি ইনফিউজ করলাম। যেমন ধরুন, ধর্মান্ধতার কথা, আমাদের যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বর্তমান, তার কথা, দেশাত্মবোধক কিছু গান, বা এলাকাভিত্তিক কিছু গান। ঝুমুর গান যখন ভবপ্রীতানন্দ ওঝা বা রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলিরা লিখছেন, এঁরা পুরোপুরি রাধা-কৃষ্ণকে বেস করে করেছেন। রাধা-কৃষ্ণকে ভিত্তি করে করতে গেলে ওটা বৃন্দাবন, মথুরা, ললিতা, বিশাখা, কদম্বতলা, এবং তাঁদের যে রাসলীলা, এইসব নিয়ে গানটা হচ্ছে। আমি দেখলাম যে, সেটাতে বোঝা যাবে না এটা কোন এলাকার গান। ঝুমুর গান যে এই এলাকার গান, এই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বা আমাদের মানভূম, বা এই পার্শ্ববর্তী ছোটনাগপুরের গান, সেই গানে যদি মথুরা-বৃন্দাবনের কথা থাকে, তাহলে সেটা ঠিক ধরা যাবে না। যে এলাকার লোকসঙ্গীত, সেই এলাকার একটা চিত্র তো অটোমেটিক্যালি চলে আসবে সেই গানে, সেটাই আসা উচিত। যেমন, যখন আমরা ভাটিয়ালি গান শুনি, তখন পদ্মা নদীর গান, গঙ্গা নদীর গান শুনছি। এই গানে নদীর কথা থাকছে। আমি প্রথমত ভাবলাম, আমাদের কাঁসাই, শিলাই, সুবর্ণরেখা, দামোদর, কুমারী , এই নদীগুলোকে নিয়ে যদি গান করা যায়, বা এখানকার যে অযোধ্যা পাহাড় , বাঘমুণ্ডি পাহাড়, বা আমাদের যে ডুংরি, শাল-পিয়াল-মহুল বন, এই যে প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে, সেটাকে যদি আমরা ঝুমুরে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে এটা কীরকম হয়!  আমি এখানে প্রথমত মানভূমী ভাষা অর্থাৎ এখানকার কথ্য ভাষার  উপরে কিছু কম্পোজিশন করলাম। এখানকার নিজস্ব ভাষা, এখানকার প্রবলেম, এখানকার মানুষজন, তাদের ভালবাসার ধরন,  দুঃখ-কষ্ট—এই সব মিলিয়ে জীবনের একটা পরিপূর্ণ চিত্র কে    ঝুমুরের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।   আমিই প্রথম ‘বল রে কাঁসাই নদীর জল, বল রে শিলাই নদীর জল’ বা ‘মানভূম কেইসন সুন্দর’ বা ‘টুসু ভাদু করম গান/ঝুমুরে বহাই বান’ এরকম গান লেখা শুরু করলাম। এখানের যে লোকসংস্কৃতি, বা এখানে যেসব দ্রষ্টব্য স্থান আছে, সেগুলোকে যাতে ইনক্লুড  করা  যায়, সেইটার পুরোপুরি  চেষ্টা করলাম। শাল-পিয়াল-মহুল বনের যে সৌন্দর্য, অযোধ্যা পাহাড় বা বাগমুণ্ডি পাহাড় বা পঞ্চকোট পাহাড়ের যে সৌন্দর্য, বা এখানে এ দেউলঘাটা বা পাকবিরা আছে, টুসু উৎসব, করম উৎসব, এগুলো নিয়ে এলাম গানের কথায়।   প্রথমটা আমাকে অনেকে বলেছিল যে, এগুলো তো গান হচ্ছে না। কিন্তু পরে দেখা গেল, এগুলোকে সবাই অ্যাক্সেপ্ট করছে।

সো. দা.: মানে আপনি এখানে বলতে চাইছেন যে, আদিযুগে যেমন ঝুমুর ছিল, মূলত মানুষের জীবনযাত্রার গান, আপনারা সেটাকেই আবার ফিরিয়ে আনলেন?

সু. মা.: হ্যাঁ। এইরকম একটা প্রচেষ্টাই আমি চালালাম। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা , তাদের নানাবিধ সমস্যাগুলোকে গানের মধ্যে আনলাম, গানের ভাষা এবং ভাবের বিভিন্ন  এক্সপেরিমেন্ট করলাম। যেমন ধরুন এই গান টা—‘গতর খাটাই গতর খাটাই/মেয়ে মরদ মাটি কাটাই/পাথর ফাটাই ডুংরি পাহাড়ে/আহারে তাউ আমার ভাত নাই আইজ ঘরে।‘—এখানেমূলত আঞ্চলিক নানা সমস্যার  (যেমন এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই,  রাস্তাঘাট নেই)   কথাগুলোই  মানুষের মধ্যে একটা সেনসেশন ক্রিয়েট করে। যেমন, যখন পাহাড়-জঙ্গল  নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি লিখলাম-‘শাল কাঁদে পিয়াল কাঁদে/কাঁদে মহুল বন/অযোধ্যা পাহাড়ে বস্যে কাঁদে হামার মন/এই তিরিং রিঙ্গা গাছ গিলা/কথালে যে আল্য/দেখাল্য দেখাল্য খেইল বাবুরা দেখাল্য।‘ বা, ‘পাত তুড়ি নিতি নিতি/ঝুড়ি-ঝাঁটি দাঁতন কাঠি/আজ কেন বাবুই করে মানা গো/উহাদের বন নাই ছিল জানা গো।‘ এই যে জঙ্গলকেন্দ্রিক সমস্যা—তখন আদিবাসীদের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে দিত না, তাদের জরিমানা করত,তাদের জঙ্গলকেন্দ্রিক যে জীবন—জঙ্গলের পাতা আনত, তারপর ওই দাঁতন কাঠি এসব বাজারে বিক্রি করে কিছু পয়সা রোজগার করে, কিছু কাঠ ওরা নিজেরা ব্যবহার করে জীবন চালাত—এই ব্যাপারগুলো, মানে জঙ্গলের যে অধিকার,  যেখানে ওরা জঙ্গলটাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে, সেগুলো বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। পরবর্তীকালে এই ধারণাগুলোও অনেক পালটে গেছে। অযোধ্যা পাহাড়ে এখন আর ইউক্যালিপ্টাস প্ল্যান্টেশন হয় না, এখন শাল মহুলের প্ল্যান্টেশনটাই করার চেষ্টা করছে ওরা। বা এই যে গ্রাম কমিটি গঠন করেছে ওরা, বনরক্ষা কমিটি তৈরি  করেছে, লোকাল লোকজনকে নিয়েই একটা কমিটি বানিয়েছে। জঙ্গল এলাকায় যারা বসবাস করে, তাদেরকে সেই পাট্টা (জমির ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত দলিল) দেওয়া, এইগুলো গভর্নমেন্টের তরফ থেকে অনেক চেঞ্জ হয়েছে। এইগুলোকে আমি মোটামুটি গানের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

সো. দা.: আপনি ঝুমুরের পদে অশ্লীলতার প্রসঙ্গে বলছিলেন যে, স্বাধীনতার পরে একটু কম প্রতিভাবান ঝুমুর শিল্পীদের হাতে পড়ে ঝুমুর একটু অশ্লীল জায়গায় চলে গিয়েছিল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ‘অশ্লীলতা’ কথাটা কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে? এটা কি শুধুমাত্র উত্তেজনা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল বলে অশ্লীল বলছেন?

সু. মা.: দেখুন, যে সময়টার কথা আমি বলছি, সেই সময়টা তো অনেক কনজারভেটিভ ছিল । সেই অর্থে অশ্লীল বলা যায় না। অশ্লীলতা বলতে নাচনিদের অশ্লীল বলা হত, সেটার বিরুদ্ধে কিন্তু আমরা ফাইট করেছি, যে, নাচনি কীভাবে অশ্লীল হয়! কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু অন্য ধরনের কথাবার্তা ছিল, যেমন-‘মদনের পঞ্চবাণ’ বা ‘পতি নাই পালঙ্ক উপরে/প্রাণ কাঁদে মদনের সরে’। এগুলোকে ঠিক অশ্লীল বলা যায় না। কিন্তু ব্যাপারটা হল, নাচনিরা এই যে পরিবেশন করত নাচটা, তখন কিন্তু সারারাত ধরে নাচটা পরিবেশন করত। ভোরবেলার দিকে পাবলিক ডিমান্ড অনুযায়ী কখনও হয়ত ভোজপুরী নাচ নাচতে হল বা ভোজপুরী একটা গান চালিয়ে দিল। এইরকম কিছু অশ্লীল গান নাচনি নাচে ব্যবহৃত হত, কিন্তু সেটা তখনকার দিনে অশ্লীল। কিন্তু এখন তো অশ্লীল কিছুই নয়। এমনিতে তো আমরা ঝুমুর গান লিখেছি, ঝুমুর গান গাইয়েছি, ঝুমুর গানের আসর বসিয়েছি ঠিক আছে, এইটা একধরনের ফাইট। উল্টোদিকে, ঝুমুরের জন্যে কিন্তু আমরা পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সর্বত্রই লড়েছি। নাচনিরা যেহেতু অন্য ধরনের সিচুয়েশন থেকে আসছে, ওদের সহানুভূতিটা দেখানো উচিত। সমাজ ওদেরকে ঠিকমতো অ্যাক্সেপ্ট করে না, ওরা অনেক দরিদ্র বাড়ি থেকে আসছে এবং শিল্প চর্চা করছে। তাদেরকে বলতে পারা যায়, নির্যাতিতা মহিলা। তো সেটা পরবর্তীকালে সবাই স্বীকার করেছে। নাচনিদের উপর দৃষ্টিভঙ্গিটা কিন্তু পালটে গেছে। যেমন, আমরা সেন্টার ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড কালচারাল অ্যাক্সেন্ট থেকে সর্বপ্রথম সিন্ধুবালাকে (উল্লেখযোগ্য নাচনি শিল্পী সিন্ধুবালা দেবী) একটা পুরস্কার দিই। তখন তথ্য-সংস্কৃতির যিনি ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন, মানিক সরকার, তাঁকে দিয়ে পুরস্কারটা দেওয়াই। এরপর সিন্ধুবালাকে লালন পুরস্কার দেওয়া হল, অ্যাকাডেমি পুরস্কার দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে পস্তুবালাকে (পস্তুবালা  কর্মকার) পুরস্কার দিয়েছে, বিমলাকে দিয়েছে, সরস্বতীকে দিয়েছে। এইটা নিয়ে আমরা ফাইট করলাম যে, না, ঝুমুর গান অবশ্যই গাওয়া যায় এবং আজকে, এই বিভিন্ন ধরনের গান নিয়ে একটা কালচারাল রেভোলিউশন যখন আমরা করলাম, একটা গঠনমূলক আঙ্গিকও রাখলাম, আবার একটা লড়াইয়ের মানসিকতা নিয়েও করলাম। তার ফলে এটা কিন্তু সাক্সেসফুল। ঝুমুর সম্পর্কে আজকে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে গেছে। আজকে কলকাতার শিল্পীরাও ঝুমুর গান গাইছে, এই যে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে, যেমন, ওড়িশা, অসমে, দেখা যাচ্ছে যে, ঝুমুর গানের একটা ভাল মার্কেট তৈরি হয়েছে। তারা ভাল পরিবেশন করতে পারছে, এবং বেশ নাম করছে।