রাঢ়বঙ্গের আপাত রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে যে গানের ব্যপ্তি, সেই গানের ধারা বা চরিত্রেও যে সেই একই স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে, এ আর আশ্চর্যের কী! এই অংশে ঝুমুরের কয়েকটি বিশেষ দিক সহ তার বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করা হবে।মূলত, ‘পুরুল্যা’, অর্থাৎ যে জেলাকে পুরুলিয়া বলা হয়ে থাকে, সেই অঞ্চলের ঝুমুরের উপরই এই বিশ্লেষণের আলোকপাত করা হবে। কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস জড়িয়ে আছে যে গানের সঙ্গে, সেখানে সময়ের প্রয়োজনে ঝুমুরের ক্রমবিবর্তনটি একটি অবশ্য লক্ষণীয় বিষয়। তবে শুধুমাত্র সময়োপযোগী এই বিবর্তনই নয়, ঝুমুর এর আরও একটি লক্ষণীয় উল্লেখযোগ্য বিষয় হল অঞ্চলভেদে তার নানা গঠনগত ও সুরগত বৈচিত্র্য। পুরুল্যা জেলার বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগ, পুরুল্যা সদর, বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর, পাতকুম—এরকম প্রতিটি অঞ্চলের ঝুমুরে সূক্ষ্ম পার্থক্য লুকিয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অন্যান্য যেসব জায়গায় ঝুমুর প্রচলিত, যেমন বাঁকুড়া বা ঝাড়গ্রামে, সেখানকার ঝুমুর আবার পুরুল্যার ঝুমুরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশার ঝুমুরও যে এককভাবে স্বতন্ত্র্য, তা বলাই বাহুল্য।
আদিযুগ থেকে আধুনিক যুগ: ঝুমুর গীতির ক্রমবিবর্তন
ঝুমুরের আদিযুগ বলতে গবেষক গিরীশচন্দ্র মহন্ত যে ভাগটি করেছিলেন, সেটি ছিল ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পূর্ববর্তী যুগ। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা ঝুমুর নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা খানিক অন্যভাবে এই যুগকে চিহ্নিত করতে চান। তাঁদের মতে, লিখিত ঝুমুরের আগে যে ‘ভণিতাহীন’ ঝুমুরগুলি লোকেমুখে গাওয়া হত, সেগুলোই আসলে ঝুমুরের আদিরূপ। এই সময়ের বেশিরভাগ ঝুমুরই আর পাওয়া যায় না এবং যেহেতু এই ঝুমুরগুলি মুখে মুখে রচিত হত, ফলে গীতিকার কবিদের নামও পাওয়া যায় না। তবু যে পদগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি পড়লেই বোঝা যায়, মানুষের দৈনন্দিন গ্রাম্য জীবনের কথাই সেখানে মূলত উঠে এসেছে ছন্দের মাধ্যমে। দৈনন্দিন চিত্র ছাড়াও মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, সমাজব্যবস্থা, পালাপার্বণের কথাও সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণ-স্বরূপ বেশ কিছু পদের উল্লেখ এখানে করা হল –
ঝুমুর – ১
‘ডুব্যে ডুব্যে মাছ ধরি শুধাই পুঁটি টেংরা
অ ছট দেঅরা,
মালি ফুলে বইসল্য ভমরা।’
(অর্থ – জলের মধ্যে ডুবে পুঁটি, ট্যাংরা ইত্যাদি নানা ছোট প্রজাতির মাছ ধরছেন কোনও এক গ্রাম্য গৃহবধূ। সেইসময় ফুলে ভ্রমর বসতে দেখে তিনি ছোট দেবরকে সে কথা বলছেন।)
ঝুমুর – ২
‘কাঁসাই-কুমহারী নদী, সে নদী পাতাল ভেদী
নদী পারে ভুলেঞ বিটি দিহনা, মরিলে খভর মিলে না’
(অর্থ – এটি আসলে গ্রাম বাংলার কোনও এক খণ্ড চিত্র যেখানে জনৈক ব্যক্তি তাঁর কোনও প্রিয়জন বা কোনও প্রতিবেশীকে মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে উপদেশ দিচ্ছেন ঃ নদী-তীরবর্তী কোনও ঘরে যেন মেয়ের বিয়ে তিনি না দেন। কাঁসাই-কুমহারী অর্থাৎ পুরুল্যা অঞ্চলের প্রধান দুই নদী কংসাবতী ও কুমারী, এই দুই নদীই অত্যন্ত গভীর, অতলস্পর্শী। তাই সেখানে মেয়ের ভালোমন্দ কিছু ঘটলে সে খবর আসবে না। মেয়ের জীবনের মতো সে খবরও যেন তলিয়ে যাবে অতলে।)
ঝুমুর – ৩
‘ডালিমের গাছটি ভারি ঢেঁড়া দিয়ে ডালিম পাড়ি
অই ডালিম রাখ মাঝ্যাঘরে, খিদা পাল্যে খাব অন্ধকারে।’
(অর্থ – ডালিম গাছ থেকে ঢেঁড়া অর্থাৎ আঁকশি দিয়ে ডালিম পাড়ার কথা এখানে বলা হয়েছে। সেই ডালিম ‘মাঝ্যাঘর’ অর্থাৎ কিনা ভাঁড়ার ঘরে মজুত করে রাখতে হবে । ‘অন্ধকারে’ খাওয়ার কথা হচ্ছে, কারণ, খুব সম্ভবত গাছের মালিক অন্য কেউ, তাই অন্ধকারে খেলে তাঁর চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম।)
গানের কথায় স্থানীয় সমাজচিত্রের এই যে ব্যবহার, এর পরিবর্তন ঘটল ঝুমুরের মধ্যযুগে, বা বলা ভালো, চৈতন্যদেব-পরবর্তী যুগে। ভণিতাযুক্ত ঝুমুরের এই যুগে ঝুমুরের কথায় এসে মিশছে বৈষ্ণবতত্ত্ব, হিন্দু, শাক্ত, সহজিয়া, বৌদ্ধ, জৈন, সগুণ, নির্গুণ, জন্মান্তরবাদ, ভক্তিবাদ, দেহতত্ত্ব, রামায়ণ, মহাভারত এবং নানা পৌরাণিক কাহিনী। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ও তাঁর প্রভাব থেকে যদি এই মধ্যযুগের সূচনা ধরা যায়, সেক্ষেত্রে একথা পরিষ্কার, যে এই যুগটি ঝুমুরের দীর্ঘতম যুগ। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন ঝুমুরের কিংবদন্তি কবিগণ। অষ্টাদশ শতকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে বরজুরাম দাস, উদয় কর্মকার, বিনন্দিয়া সিং, গৌরাঙ্গিয়া সিং, উনবিংশ শতকে রামকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়, অক্ষু কর্মকার, নরোত্তম সিং মানকি, ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, দুর্যোধন দাস, গদাধর চৌধুরী, চামু কর্মকার, তুলসী দাস, পীতাম্বর দাস, রামচরণ দাস, সৃষ্টিধর সিং মাহাত ও বিংশ শতকের প্রথমভাগে দীনবন্ধু তন্তুবায় (দীনা তাঁতি), পরেশ কর্মকার, দ্বিজ টিমা, হরিপদ দেওঘরিয়া প্রমুখ কবিদের নাম অবশ্য উল্লেখ্য। এই কবিরা নিজ প্রতিভাবলে প্রভূত খ্যাতি ও সম্মান পেয়েছিলেন তো বটেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা।
এই সময়ে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে বরজুরাম দাস, রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলী, ভবপ্রীতানন্দ ওঝার নাম যেকোনো ঝুমুর শিল্পীর কাছেই দেবতুল্য। এঁদের সকলের লেখাতেই রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক ঝুমুর বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। মূলত, রাজার দরবারের জন্য গাইলেও এঁরা সকলেই নাচনি আসরে গান গাইতেন। নাচনি প্রথার শুরুই হয়েছিল বরজুরামের হাত ধরে। রামকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পারিবারিক জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল নাচনি আসরে ঝুমুর গাওয়ার কারণে। তারপরেও, শিল্পের খাতিরে তিনি যে ঝুমুরকে ছেড়ে যাননি, এ এক বিস্ময়। রামকৃষ্ণ-রচিত একটি বিখ্যাত ঝুমুর হল ঃ –
কাচ মরকত নবীন জড়িত সুকোমল তনু শ্যামল
তার ভুরুদুটি আঁকা বামে ঈষৎ বাঁকা
বাঁকা আঁখি দুটি ঢল ঢল।
দেখে যা সখী ভরিয়ে আঁখি
নাগর, রূপে বন কত করে আলো।
(অর্থ – এখানে শ্রীরাধা তাঁর সখীর কাছে শ্রীকৃষ্ণের দেহরূপের বর্ণনা দিচ্ছেন। কাচ ও মরকতে (হরিদ্রাভ মণি) শোভিত শ্যামবর্ণ কৃষ্ণের মায়াবী চোখ দেখেই রাধা তাঁর প্রেমে আত্মহারা। তাঁর যুবা-রূপে সমস্ত অরণ্য যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে।)
রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক আরও একটি ঝুমুরের উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক, যেখানে আবার কৃষ্ণ রাধার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ। ভবপ্রীতানন্দের এই ঝুমুরটি এরকম ঃ
কামিনী কুন্তলজান সেহোজাল মহাজাল
বাঝিগেলো বাঝিগেলো গে ধনি রসিকানাগর
রং।। কি বাঝিগেলো।।
কটাক্ষ ভ্রূভঙ্গ রঙ্গে অনঙ্গের বাণ সঙ্গে
মারিদেলি মারিদেলি গে ধনি হরিণা সমান
রং।। বাণে মারিদেলি।।
দেখায়ে মধুর হাঁস লাগালি পীরিতি ফাঁস
বান্ধিলেলি বান্ধিলেলি গোধনি চোর সমান
রং।। পাশে বাঁধি লেলি।।
অলিরে কমলমধু চকোরাকে যৈসন বিধু
মোরা লেখে মোরা লেখে গে ধনি তোঁহুতে তৈসন
রং।। কি মোরা লেখে।।
(অর্থ – শ্রীরাধার আজানুলম্বিত কেশে যেন পাতা রয়েছে প্রেমের ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন কৃষ্ণ। স্থানীয় মানভূমী ভাষায় ‘বাঝিগেলো’-র অর্থ যা কিনা বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। রাধিকার সুন্দর ভ্রূযুগলের দিকে তাকিয়ে প্রেমিক কৃষ্ণ যেন তীরবিদ্ধ হরিণের মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। তাঁর মধুর হাসি সেই বাঁধন আরও শক্ত করেছে। পদ্মমধুর প্রতি অলি অর্থাৎ ভ্রমর যেমন তৃষ্ণার্ত থাকে, কিংবা, জলের জন্য চাতক পাখি যেরকম আর্তনাদ করে, প্রেমের এ তৃষ্ণাও তেমনই।)
ঝুমুরে দেহতত্ত্বের প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে শ্যামল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন—‘ঝুমুরের যে গানগুলির মধ্যে অন্তর্মুখী ভাবধারা পরিলক্ষিত হয় এবং তার অভ্যন্তরে এক গূঢ় অর্থ থাকে, তাকেই অধ্যাত্ম ভাবনার সংগীত হিসাবে অভিহিত করা হয়। বাউল সাধনা, বৌদ্ধ তন্ত্র সাধনা, বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনা, সুফী সাধনা, ক্রিয়া-যোগ সাধনার সংমিশ্রণ। তেমনি ঝুমুরের অধ্যাত্ম ভাবনার বীজের অঙ্কুরিত হয়েছে বৈষ্ণব, শাক্ত, বৌদ্ধ, জৈন, বাউল সহজিয়া দার্শনিক সাধনার ভিত্তিভূমিতে। এই বিশ্ব এক মহাভাবজগতের প্রতিষ্ঠান। যার নাম ভাবনগর বা রূপনগর।’ ঝুমুরের পদে দেহতত্ত্বের উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় কবি জালিরাম কর্মকারের একটি পদ—
এই জমির জলমাটি, কর যে জন ঘাঁটাঘাঁটি
চাষের নিয়ম হয় যেন জানা
রং – খাটি ফসল হে তখন হবে ষোলআনা
পরিশ্রম বিফলে যাবে না।
সেঁচ দিয়ে জলভর, আগাছাকে দমন করে,
(যেমন) গরু, ছাগল বাগানে ঢুকে না।
জালিরাম হয়ে পামর, পায় যদি হে চাষের ভাঁউর
মিটে দিব মহাজনের দেনা।।
(অর্থ – এই কবিতাটিতে খাঁটি রূপকের ব্যবহার লক্ষণীয়। এখানে, দেহকে চাষের জমির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কৃষিজমিকে উর্বর করে তুলতে যেমন সেচ দিতে হয়, অপ্রয়োজনীয় আগাছা পরিষ্কার করতে হয়, তেমনই দেহ সাধনা করলেও ভাল ফল পাওয়া যায়।)
দেহতত্ত্বের কথা এসেছে রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলী, অক্ষু কর্মকার, দীনা তাঁতি প্রমুখ সাধকদের পদেও। আসলে, ঝুমুর সাধকরা মনে করেন, দেহে ঈশ্বরের নিবাস। দেহকে কেন্দ্র করে যে সাধন, ভজন ও যোগ-ক্রিয়া, তা আসলে অধ্যাত্মবাদের প্রতি দিক নির্দেশ করে। এই দেহতত্ত্ব-বিষয়ক ঝুমুরের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর দ্বি-মাত্রিক অর্থ—অর্থাৎ বাইরে এক অর্থ, আর অন্তর্নিহিত আরেক অর্থ, যাকে কিনা নির্গুণ দেহতত্ত্ব ও বলা হয়ে থাকে। দীনা তাঁতি-রচিত দেহতত্ত্ব ঝুমুরের একটি উদাহরণ হল—
কাষ্ঠের ভিতরে আছয়ে অনল
যতনে পাইবে রতনে।
(অর্থ – এখানে আত্মতত্ত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কাঠের সঙ্গে কাঠের ঘর্ষণে যেমন আগুন জ্বলে, তেমনই নিজসত্তার সঙ্গে আত্মার সাধনাক্রিয়ার মাধ্যমে আত্ম-প্রজ্জ্বলন সম্ভব।)
তবে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ঝুমুরে কিন্তু তত্ত্বকথার পাশাপাশি তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রও উঠে এসেছে। পীতাম্বর দাসের ঝুমুরে ব্রিটিশ-বিরোধিতা দেখা গেছে। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বীর তরুণ ক্ষুদিরামের গেয়ে ওঠা ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’-র রচয়িতা ছিলেন পীতাম্বর দাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ হওয়ায় বহু ভারতীয়কে যুদ্ধের ময়দানে যেতে হয়েছিল এবং রক্ত ঝরাতে হয়েছিল, সেই বিষয়ে তিনি লিখছেন—
রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব দেখে লাগে ধন্দ,
বাণিজ্য বন্দ, আর চলে না,
ব্যবসা হয় মাটী, কেমনে দিন কাটী,
উপায় কর খাঁটি ছাড়ব না।
(অর্থ – দুই মহাশক্তির লড়াইয়ে উলুখড় উপনিবেশের মানুষ চরম বিপদে। অর্থনীতিতে টান, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, ফলে সাধারণ সৈনিক বা মানুষের রোজগারও বন্ধ। এ অবস্থায় একটা কিছু ব্যবস্থা না করলে আর চলছে না।)
আধুনিক যুগের ঝুমুর বলতে মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ঝুমুরকেই বোঝানো হয়ে থাকে। যদিও বিংশ শতকের প্রথমভাগে আবির্ভূত কবিদের ঝুমুরকেও আধুনিক ঝুমুর বলা হয়। সেই সূত্রে সৃষ্টিধর সিং মাহাত, গদাধর চৌধুরি, চামু কর্মকার, ভীমচরণ মহন্ত প্রমুখ কবিদের ঝুমুরও আধুনিক ঝুমুর হিসেবে পরিগণিত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সমাজে ধীরে ধীরে এসেছে বিশ্বায়নের হাওয়া। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছে লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুমুরের পদে বিষয় হিসেবে রাধা-কৃষ্ণ বা দেহতত্ত্বের গুরুত্ব ক্ষীণ হয়ে এসেছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে সাধারণ মেহনতি মানুষের কথা। কিন্তু আধুনিক যুগের প্রথম দিকে টানা কয়েক দশক ঝুমুরের ভাগ্যে জুটেছে অবহেলা। এর প্রধান কারণ হিসেবে গবেষকরা দেখিয়েছেন, মধ্যযুগ বা কাব্যযুগের শেষের দিকে স্বল্প-মেধা ও মধ্য-মেধার ঝুমুর কবিদের হাতে পড়ে ঝুমুরের পদে যৌন অশ্লীলতার উপস্থিতি। ফলে, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ ঝুমুরকে পুরোপুরি বর্জন করেন। সেখান থেকে আবার ঝুমুরকে তুলে আনার পিছনে যাঁদের বড় অবদান ছিল তাঁরা হলেন এই প্রজন্মের অন্যতম ঝুমুর কবিগণ—মিহিরলাল সিংদেও, সলাবত মাহাত, সুনীল মাহাত, কুচিল মুখোপাধ্যায়, বিজয় মাহাত, সুনীল বরণ মাহাত, সুভাষ রায়, গান্ধীরাম মাহাত, নরেন হাঁসদা প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। এঁদের ঝুমুরের পদে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ছাড়াও এসে পড়েছে চিরাচরিত সমস্যার কথা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সমাজ-সচেতনতা বা পরিবেশ সচেতনতার মতো বিষয়। সুনীল মাহাতর একটি ঝুমুর গানের কিয়দংশ এখানে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে—
পৃথিবীটা জতুগৃহ
হতে পারে গৃহদাহ
যেকোন সময়
সুসময় হারিয়ে গেছে
এখন অসময়।
…
অণু পরমানু বোমায়
ছেয়ে গেছে দেশ
প্রগতির গতিতে আজ
নষ্ট পরিবেশ
পৃথিবীটা মানুষের আর
বাসযোগ্য নয়
সুসময়---।
সুনীল মাহাতর লেখা সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ঝুমুর গান, যা এখন বিদেশেও বহু বাঙালি অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়ে থাকে, সেই ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন/পালাব পালাব মন’ আবার একটি সাধারণ গৃহস্থজীবনের আঙ্গিকে প্রকৃতিপ্রেমকে তুলে ধরছে। তবে সচেতনতার কথা বলতে গেলে ভিখারিচেলিয়ামা গ্রামের এক অখ্যাত ঝুমুর শিল্পী, বিশ্বম্ভর পরামানিকের একটি গান এখানে দেওয়া যায়, যেখানে তিনি বনসৃজনের কথা লিখছেন—
১। বনজ সম্পদ, উচ্ছেদে বিপদ, জলবায়ু অল্প
(এই) বাঢ়িবে দূষণ।।
রংঃ- শুন রাজ্যবাসীগণ, আমি করি নিবেদন
(সবে) বন কর রক্ষণ।।
২। গ্রাম্য (রাজ্য)বাসীগণ, বন কর রোপণ
বন কর সৃজন করিয়া যতন।।
৩। গাছ গাছড়াদি, মুক্ত করে ব্যাধি
ফলে ফুলে অতি মধু আশ্বাদন।।
৪। বন্যপ্রাণী কত, আছে শত শত
(তাদের) না মার জীবন, না কর তাড়ন।।
৫। ঋতু আগমনে, বিহঙ্গের গানে- (হেন) বিশ্বম্ভরের ভনে,
শুনে জুড়ায় জীবন।।
অতএব, তিন যুগের ঝুমুরের বিবর্তনের সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় এই যে, আদি যুগের ঝুমুরে মূলত যে মানবসমাজের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেই চিত্রের বদল ঘটেছে মধ্যযুগের ঝুমুরে, যেখানে অনেক বেশি কাহিনী ও তত্ত্ব-নির্ভরতা প্রাধান্য পেয়েছে। আবার ও আধুনিক যুগের ঝুমুরে সেই দৈনন্দিন জীবনের চিত্রই ফিরে এসেছে।
ঝুমুর’এর আঞ্চলিক সীমাবধ্যতার কারন
কাব্যযুগের (মধ্যযুগের) ঝুমুর শিল্পীদের নিয়ে যেসব লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে, সেগুলি পড়লেই একথা খুব স্পষ্ট হয় যে, সেযুগে ঝুমুর শিল্পীরা কতখানি সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। শুধু সাধারণ সমাজেই নয়, রাজন্যবর্গের কাছেও তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন প্রিয়পাত্র, ভরসাস্থল। ঝুমুর সাধক গৌরাঙ্গিয়া সিং ছিলেন বাঘমুণ্ডীর রাজার বিশেষ ঘনিষ্ঠ, যিনি আবার ছিলেন পঞ্চকোট-রাজের অধীনে। একবার বাঘমুণ্ডী অঞ্চলে অনাবৃষ্টির কারণে প্রজারা খাজনা দিতে না পারায় বাঘমুণ্ডীর রাজাও পঞ্চকোট-রাজকে পর্যাপ্ত কর দিতে পারেননি। পঞ্চকোট-রাজ ফরমান পাঠালে গৌরাঙ্গিয়া পঞ্চকোটে উপস্থিত হন দূত হিসেবে। তাঁর গলায় ঝুমুর শুনে রাজা কর তো মাফ করলেনই, সঙ্গে গৌরাঙ্গিয়াকে দিলেন সশ্রদ্ধ উপহার। শোনা যায়, বিনন্দিয়া সিংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর নির্দেশমতো তাঁর প্রিয় একতারাটিও সমাধিস্থ করা হয় কিন্তু পরে সমাধি খনন করলে দেখা যায়, বিনন্দিয়ার শবদেহ ও একতারা দুইই উধাও। জগৎ কবিরাজের সম্পর্কে এই প্রবাদ প্রচলিত আছে, তিনি শুধুমাত্র ঝুমুর গান গেয়ে এক কর্কট রোগাক্রান্ত রোগীকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। রামকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়েরবাড়িতে ডাকাত পড়ার সময়েও তিনি গান গাইছিলেন, সেই গান শুনে ডাকাতরাও নাকি বিভোর হয়ে যায়। পরেশ কর্মকার নাকি একবার বাঘের সামনে পড়ে শুধুমাত্র গানের কল্যাণে বাঘের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পান। এমন আরও নানা গল্প-কিংবদন্তি কথা প্রচলিত রয়েছে অন্যন্য কবি যেমন উদয় কর্মকার, বরজুরাম দাস, অক্ষু কর্মকার, চামু কর্মকারদের নিয়েও। বেশিরভাগই হয়তো মিথ। কিন্তু বাস্তবের আঙ্গিকে এইসব গল্পকে বিচার করলে গল্পের প্রেক্ষিতকেই ভুলতে বসব আমরা। ঝুমুর গানের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, জনমানসে তার বিপুল প্রভাব, তৎকালীন সমাজে তার অবস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলি বুঝতে গেলে সেখানে এইসব কল্পকাহিনীকেও স্থান দেওয়া প্রয়োজন।
এবার স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন আসতে পারে যে, প্রায় হাজার বছর যে সংস্কৃতির বয়স, লক্ষ লক্ষ মানুষ চর্চা করেছেন যে সংস্কৃতির, যে সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত মানুষদের নিয়ে রটেছে এমন নানা গল্প, সেই সংস্কৃতি অনেকাংশেই একটি বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল কেন? বাউল বা ছৌ যেভাবে আজ বিদেশেও বহু জায়গায় সমাদৃত হচ্ছে, ঝুমুর সেভাবে সেই সমাদর পেল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গে ঝুমুরের আঁতুড়ঘরে, সেই পুরুল্যাতে। সুনীল মাহাত বা কুচিল মুখোপাধ্যায়ের মতো বর্ষীয়ান গবেষক-সাধকের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে কারণটি বিশেষভাবে উঠে আসে, তা হল, ঝুমুর যেহেতু একসময় নাচনি নাচের সময়েই গাওয়া হত তাই তথাকথিত ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজ এই গানকে বর্জনই করে এসেছে। অর্থাৎ, একথা খুব পরিষ্কার যে ঝুমুরের বর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের বর্ণবাদী ও শ্রেণিবাদী সংস্কারের বেড়াজাল।
কুচিল মুখোপাধ্যায়ের বয়স বর্তমানে পঁচাত্তর-উত্তীর্ণ। (চিত্র ১) কুলীন ব্রাহ্মণ-সন্তান হওয়ায় তাঁর ঝুমুর গান-প্রীতি অতি অল্প বয়সেই তাঁকে পরিবার-চ্যুত করে। সদ্য-যুবা বয়সের সেই কাহিনীটি রীতিমতো রোমহর্ষক এবং একইসঙ্গে বেদনাদায়ক। ১৮–১৯ বছর বয়সে পাশের গ্রামে লুকিয়ে নাচনি আসরে গিয়েছিলেন। সেখানে, রসিক না আসায় তাঁকেই সকলে ঝুমুর গাইতে বলে। ততদিনে তিনি যে ঝুমুর লিখছেন ও চর্চা করছেন, তা অনেকেই জেনে গিয়েছিল। কিন্তু সেই আসরে হঠাৎ বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। রোগা চেহারার কুচিলকে তাঁর এক পরিচিত জোয়ান লোক প্রায় বগলদাবা করে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যান। কিন্তু তখনও তিনি জানেন না, তাঁর জন্য কী বিপদ অপেক্ষা করছে। তাঁর মেজদাদা ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী মানুষ। ভাইয়ের ঝুমুর শুনতে যাওয়ার এহেন ‘স্পর্ধা’ তিনি বরদাস্ত করেননি। কুচিলকে অমানুষিক প্রহারের পর একটি কুঠুরিতে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। পরদিন তাঁর এক নিঃসন্তান পিসি এসে পড়ায় সে যাত্রায় উদ্ধার পেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে পিসির কাছে থেকেই তিনি উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। বাংলায় স্নাতকোত্তর হন। সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু ঝুমুরকে ছাড়তে পারেননি কোনোভাবেই। বহু ঝুমুর কবিতা, গান ও নাটক লিখেছেন। বহু চলচ্চিত্রেও গান গেয়েছেন, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। চিত্র-পরিচালক তরুণ মজুমদারের সজনী গো সজনী ছবিতে কিংবদন্তি সুরসাধক ভি. বালসারার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বালসারাজি নিজে তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুম্বই পাড়ি দেওয়ার। এই কুচিল মুখোপাধ্যায়ের কাছেই শোনা, ব্রাহ্মণসন্তান হয়ে ঝুমুর চর্চা করার ফলে কী ঘোরতর অন্ধকার নেমে এসেছিল উচ্চাঙ্গ-ঝুমুর শিল্পী রামকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনেও। ঝুমুরের ইতিহাসে রামকৃষ্ণের মতো উচ্চাঙ্গ-সাধনায় এমন পারদর্শী শিল্পী খুব কমই এসেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ঝুমুর নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে। অথচ, নাচনি আসরে গান গাওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রী ও পুত্র উভয়েই আত্মহত্যা করেন। চরম মানসিক আঘাতে রামকৃষ্ণও এই পথ বেছে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে নিরস্ত করেছিলেন ইচাগড়ের রাজা। রামকৃষ্ণ ইচাগড়ের রাজসভায় সভাকবি ছিলেন।
সুনীল মাহাত, যাঁর দীর্ঘ চার দশকের লড়াইয়ের পর ঝুমুর আজ আবার সেই হৃত গৌরব ফিরে পাচ্ছে, সেই মানুষটিকেও একসময় বিপুল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ঝুমুর অনুশীলন করার জন্য। (চিত্র ২) তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বেশ কিছু বিষয় উঠে আসে। বাউলের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন একটি বড় ভূমিকা ছিল, ঝুমুরের ক্ষেত্রেও তেমন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান কোনও ব্যক্তি যদি এগিয়ে আসতেন, তাহলে ঝুমুরও আজ সেই জায়গায় পৌঁছে যেত। এছাড়া, যে সময় ভারতীয় বিনোদন জগতে এসেছেন প্রখ্যাত সব সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব, ঠিক সেইসময়ই ঝুমুর কিনা পড়ে আছে অবহেলার অন্ধকারে। ফলত, শহুরে দর্শকের কাছে তো বটেই, গ্রামীণ দর্শক সমাজেও কখনোই উচ্চমানের বিনোদন হিসেবে সেভাবে স্থান করে নিতে পারেনি ঝুমুর। সেই অবস্থা থেকে যে লড়াইটা তাঁরা শুরু করেছিলেন, সেই লড়াইয়ের ফলে আজকে একটা জমি পেয়েছে এই শতাব্দী-প্রাচীন শিল্প। শুরু হয়েছে নানা প্রকল্প, শিল্পীরা পাচ্ছেন নানা অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে এই শিল্পের প্রতি, কলকাতার জনপ্রিয় গায়করাও এখন ঝুমুর গান গাইছেন, বেশ কিছু সমান্তরাল চলচ্চিত্রেও ঝুমুরের ব্যবহার আগের থেকে বেড়েছে, কিন্তু এখনও অনেক পথ চলা বাকি।
ঝুমুরে বর্তমানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। হারমোনিয়াম, তবলার ব্যবহার এখন যথেষ্ট। এই মিশ্র-সাংস্কৃতিক প্রবণতা কি কোনোভাবে ঝুমুরের চারিত্রিক ক্ষতি করছে না? সুনীল মাহাত ও কুচিল মুখোপাধ্যায় দুজনেই অবশ্য ঝুমুরের স্বার্থে এই আধুনিক বাদ্যের ব্যবহারকে স্বাগত জানাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের মতে, যুগের হাওয়াকে মেনে নিতেই হবে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের কাছে ঝুমুর যাতে পৌঁছয়, সেজন্য বিদেশী বাদ্যযন্ত্র, যা কিনা অবশ্যই সুরের উপযুক্ত হবে, তার ব্যবহার অনায়াসে হতে পারে। সেখানে কোনো সাংস্কৃতিক বিভাজন থাকা উচিত নয়।
নাচনি প্রথা: উৎপত্তি, সমৃদ্ধি, অবহেলা ও অবলুপ্তি
মানভূম অঞ্চলে নাচনি প্রথা শুরু হয়েছিল উত্তর ভারতের বাঈজি নৃত্য-সংস্কৃতির অনুকরণে। শুরু করেছিলেন মধ্যযুগীয় শিল্পী বরজুরাম দাস। যদিও ততদিনে মেয়েদের কেন্দ্র করে সমাজে রক্ষণশীলতা জাঁকিয়ে বসেছে পুরো মাত্রায়। এই প্রসঙ্গে যে কাহিনীটি প্রচলিত, তা হল, বৃন্দাবনের রাস উৎসব দেখে এসে বরজুরাম বেগুনকোদরের জমিদার-গৃহিণীকে এই উৎসবের বর্ণনা করলে গৃহিণী তাঁকে সেই উৎসব হাতে-কলমে অভিনয় করে দেখাতে বলেন। বরজুরাম সেই পালায় নিজে কৃষ্ণ সাজেন, গোপিনীদের ভূমিকায় অভিনয় ও নৃত্য পরিবেশন করেন জমিদারদের রক্ষিতার মেয়েরা, কারণ, রক্ষণশীল সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে-বউ এই অভিনয়ে অংশ নিতে অপারগ। এই প্রথা ক্রমে রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
নাচনিদের ইতিহাসে যিনি সর্বাধিক খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন সিন্ধুবালা দেবী। তিনি ও তাঁর রসিক চেপা মাহাত কাশীপুরের রাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। এতটাই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা যে, সেসময় অন্য কোথাও অনুষ্ঠান করতে গেলে অন্যান্য নাচনিদের যেখানে রাজ-অনুমতি নিতে হত, সেখানে সিন্ধুবালা সেই অনুমতি ছাড়াই যেতে পারতেন। স্বাধীনতার পরেও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি । বৃদ্ধ বয়সে তিনি প্রভূত পুরস্কারে ভূষিত হন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালন পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদান করা স্টেট অ্যাকাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি অজস্র সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু, সিন্ধুবালার মতো সৌভাগ্য সকলের ছিল না। এমনিতেই নাচনিদের প্রতি সাধারণ সমাজের সমর্থন কোনোদিনই ছিল না। রাজবর্গের সমর্থনটি ছিল বলে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে তাঁরা স্বচ্ছল অবস্থায় ছিলেন। স্বাধীনতার পর রাজা-জমিদাররা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লে আর সেই সমর্থনটাও থাকেনি। ফলে, নাচনিরা হয়ে পড়েন অবহেলিত এক সমাজের প্রতিনিধি। যিনি নাচনি রাখেন, তাঁকে বলা হয় রসিক। রসিককেই নাচনিরা জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন, তাঁর পদবীই ব্যবহার করেন। কিন্তু এর পিছনে থাকে এক করুণ লড়াইয়ের ইতিহাস। তপন কর তাঁর অসামান্য মানভূম গ্রন্থে লিখেছেন—‘রসিকদের কাছে নাচনীরা কুল ছেড়ে আসে নানা পথে। এদের মধ্যে পথভ্রষ্টা নারীর সংখ্যাই সর্বাধিক। প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে প্রেমিককে হারিয়ে তারা কখনো পথহারা পাখি, কখনো প্রবলের অত্যাচারে জাত-কুল খোয়াতে বাধ্য হয়েছে, কখনো অভিভাবকের অসহায় অবস্থার সুযোগে রসিকের কাছে বিক্রী হয়ে গেছে। বহু নাচনীর সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলে দেখেছি তারা কেউই শৈশবে নাচনী হবার স্বপ্ন দেখেনি। কারণ এ জীবন অনেক ক্ষেত্রে সুখের হলেও নারীর কাম্য জীবন নয়।’ কিন্তু কেন এই শিল্প-জীবন কাম্য নয়, সে কথা লেখক জানাচ্ছেন কিছু পরেই—‘এরা গ্রাম্য লোকসমাজের মনোরঞ্জনের জন্য নাচে। এই লোকসমাজ এদের কোন মর্যাদায় নেবে সেটা অনুধাবন করতে হলে এই লোকসমাজের চরিত্রটা বুঝতে হবে।’ এই চরিত্র আসলে ভয়ংকর ভাবে জাত-পাতের অন্ধকারে ডুবে। ফলে, সেখানে নাচনিদের জন্য পর্যাপ্ত সম্মান তো দূরের কথা, তাঁদের মানুষ হিসেবে গণ্যই করা হয়নি। একসময় কোনো নাচনি মারা গেলে তাঁর দেহও সৎকার করার কোনো গরজ দেখাতেন না সমাজের মানুষ। শোনা যায়, জনৈকা নাচনি রাজবালা তন্তুবায়ের দেহ ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছিল।
বর্তমান প্রজন্মের একজন উল্লেখযোগ্য নাচনি শিল্পী হলেন পস্তুবালা দেবী কর্মকার। (চিত্র ৩) ২০১৮ সালে লালন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। রসিক বিজয় কর্মকারের পদবী অনুযায়ীই তাঁর পদবী কর্মকার। কিন্তু এই অধিকার গ্রহণের পিছনের ইতিহাসটাও একইরকম করুণ। পস্তুবালার মা বিমলা মুদিও ছিলেন একজন নাচনি। তিনি ছিলেন জমিদারের নাচনি, যাঁর পদবী ছিল সিং সর্দার। পস্তুর জন্মের আগেই তাঁর বাবা মারা যান, ফলে সিং সর্দার নামধারী মানুষটিকে পস্তু দেখেননি। শৈশবে মায়ের দ্বারাও বিবর্জিতা হয়েছিলেন পস্তু। পেটের তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি, ঝিয়ের কাজ করা, গরুর বাগালি করা, ইত্যাদি অনেক কাজই করতে হয়েছে ছোট থেকেই। দশ বছর বয়সে একজন বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাঁর। বিয়ের অব্যবহিত পরেই বৃদ্ধ স্বামী’র নির্দেশে কিশোরী পস্তুর জরায়ু বাদ দেওয়া হয়। একটা সময় ঠিক করেন, নাচনির জীবনই নেবেন। সিন্ধুবালার কাছেই নাচে হাতেখড়ি। বিজয় কর্মকার যখন তাঁর রসিক হয়ে আসেন, তখনও জানতেন না বিজয়ের বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র রয়েছে। রসিকের বাড়িতেও জায়গা হয়নি পস্তুর। নিজেই বলেছেন, রসিকের পরিবার তাঁর নাচ করে উপার্জিত অর্থটি আত্মসাৎ করত, অথচ বাড়ির চৌকাঠ পার হতে দিত না।
তারপর একসময় ২০০৩ সালে শুরু হয় আন্দোলন। অবশেষে ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নাচনিদের স্বীকৃতি দেয়। তৈরি হয় মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনি উন্নয়ন সমিতি। পস্তুবালা এখন এই সমিতির সম্পাদক। ক্রমে অবস্থা বদলেছে। ডুমারি গ্রামে রসিকের যে বাড়িতে একসময় তাঁকে আলাদা থালায় ভাত দেওয়া হত, তাঁর খাওয়ার জায়গাটিকে গোবর-জল দিয়ে ধুতে হত নিজে হাতে, সেই বাড়িতে এখন তিনি যোগ্য সমাদর পান। পুরুল্যা শহরের পাশেই সুরুল্যা। সেখানে একটি বাসস্থান দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অজস্র পুরস্কারের স্মারক ঘরটিতে। একসময় প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন তিনি। সেই আশীর্বাদ পাথেয় করেই গ্রামে-গ্রামে তাঁর নৃত্য পরিবেশন করেন তিনি। ডুবকিডি গ্রামের ভানসিংহ মেলায় তাঁর সেই নৃত্য দেখে মনে হয়েছিল, এ নৃত্য আমাদের পরিচিত ঘরানার নয় একেবারেই। এ নৃত্যের একটি নিজস্ব স্টাইল আছে, যা আমাদের শহুরে, শভিনিস্ট চোখে বিসদৃশ ঠেকতে পারে, কিন্তু তার নিজস্বতাকে উপেক্ষা করার সাহস আমাদের নেই।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও, পস্তুবালার মতো আরও যাঁরা নাচনি আছেন, যেমন বিমলা, সরস্বতী, এঁদের পর আর এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। অধ্যাপিকা প্রতিভা সরকার, যিনি পস্তুবালার দীর্ঘদিনের বন্ধু, সমাজকর্মী ও লোক-সংস্কৃতি গবেষক, তিনি আমায় বলেছিলেন, পুরস্কার কখনোই কোনো শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, দিতে পারে না কোনো আশ্রয়। এই শিল্পের পরিণতি ধ্বংসেই। আসলে নেপথ্যে রয়েছে যুগের হাওয়া। মানসিকতার পরিবর্তনের হাওয়া। সেখানে, সাবেকি শিল্পের প্রতি আর আকৃষ্ট নয় বর্তমান প্রজন্ম। তাই, ঝুমুর গবেষক থেকে কবি, সকলেই স্বীকার করেন যে, নাচনি প্রথা একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে।
সময়ের প্রয়োজনেই বুঝি ঝুমুরের সংরক্ষণ আরও বেশি করে প্রয়োজন।
গ্রন্থ তালিকা
যৌথ সম্পাদনা। “ঝুমুরের আদিযুগ”। ঝুমুর কথা, পৃঃ ৩-৬। কলকাতা: বাংলা নাটক ডট কম, ২০১৬।
--ঐ--। “ঝুমুরের মধ্যযুগ”। --ঐ--।
--ঐ--। “ঝুমুরের আধুনিক যুগ”। --ঐ--।
মাহাত, সুনীল। “পৃথিবীটা জতুগৃহ”। পিঁদাড়ে পলাশের বন, পৃঃ ১০৯। পুরুলিয়া: পুরুলিয়া জনবিকাশ মঞ্চ, ২য় সংস্করণ, ২০১৬।
চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল। “ঝুমুর সাহিত্যে দেহতত্ত্ব ও অধ্যাত্ম ভাবনা।”পুরুলিয়ার ঝুমুর (সম্পাদনা: সুভাষ রায়), পৃঃ ৯৭-১১০। বীরভূম: রাঢ় প্রকাশন, ১ম সংস্করণ ২০১৯।
কর, তপন। “নাচনীর রস ও জীবন।” অসামান্য মানভূম, পৃঃ ৭৯-৯৬। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৬।
সরকার, প্রতিভা। “নাচনি জীবন।” চার নম্বর প্র্যাটফর্ম ২০১৮।
দাস,পীতাম্বর (সংগৃহীত)। ঝুমুর সঙ্গীত। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলা ও গৌরাঙ্গলীলা গীতাবলী। ডায়মণ্ড লাইব্রেরী, সন ১৩২৯।