পশ্চিমবাংলার পশ্চিমে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূম-মেদিনীপুর জেলায় ব্যাপৃত যে অঞ্চলটি রাঢ়বঙ্গ নামে পরিচিত, তা এক অদ্ভুত স্বতন্ত্রে সজ্জিত। এখানকার কাঁকরময় পরিবেশের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যায় এখানকার সংস্কৃতি। যেসব উৎসব, পালা-পার্বণ এখানে অনুষ্ঠিত হয়, তা প্রায় সামগ্রিকভাবে প্রকৃতি ও মানুষেরই উদযাপন। পাহাড়-জঙ্গল-খনিজে সমৃদ্ধ এই দেশ মানভূম নামেও পরিচিত। আজও স্থানীয় মানুষ এই ভাষাকে মানভূমী ভাষা বলে থাকেন। ঝুমুর গান আসলে এই মানভূমী মানুষদের প্রাণ। এই গান গাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট ঋতু বা সময় নেই, প্রায় সারাবছরই এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। অবশ্যই সেখানে সুর ও বিষয়ের তারতম্য ঘটে, কিন্তু সার্বিক আঙ্গিকে তা ঝুমুরই। শতাব্দী-প্রাচীন এই সঙ্গীতকলার বয়স, বিশেষজ্ঞদের মতে, হাজার বছর। সময় ও ঝুমুরের বিষয়-বৈচিত্র্য অনুসারে ঝুমুরকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে—আদিযুগের ঝুমুর, মধ্যযুগের ঝুমুর ও আধুনিক ঝুমুর। এর মধ্যে মধ্যযুগটিকে ঝুমুরের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধের যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। কিংবদন্তি ঝুমুর রচয়িতাগণ যেমন, বরজুরাম দাস, ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, দীনবন্ধু তন্তুবায়, গদাধর চৌধুরী, রামকৃষ্ণ গাঙ্গুল্ এরা সকলেই এই মধ্যযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ঝুমুরের বিষয় আঞ্চলিক মানুষের প্রান্তিক জীবনযাপনের দৈনন্দিন চিত্র থেকে পৌরাণিক কাহিনীর কল্পনা, সাধারণ সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার কাব্যরস থেকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী কিংবা সহজিয়া দেহতত্ত্ব—এক বিস্তীর্ণ জগৎ জুড়ে তার ব্যপ্তি।
এই গবেষণার প্রথম অংশে ঝুমুরের একটি সার্বিক আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে ‘ঝুমুর’ শব্দের উৎপত্তি, ঝুমুরের বিষয়বৈচিত্র্য, ঝুমুরকে কেন পঞ্চঋতুর গান বলা হয়ে থাকে এবং সময়ের সঙ্গে ঝুমুরের অবহেলা ও অবক্ষয়ের চিত্রটি আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে সময়ের সঙ্গে ঝুমুরের বিবর্তনের চিত্রটি তিনটি যুগের পদের উদাহরণসহ ব্যক্ত করা হয়েছে। এই অংশে ঝুমুরের বর্তমান অবস্থা, সেইসঙ্গে নাচনি শিল্পীদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণটিও যথাযথ উদাহরণ-সহ আলোচনা করা হয়েছে। এমন এক প্রাচীন ও সুবিশাল সাহিত্য-জগতটির সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজে কেন তেমন আলোচনা বা গবেষণা এখনও অবধি করা হয়নি, সেই কারণটিও এই অংশে অনুসন্ধান করা হয়েছে। তৃতীয় অংশে একজন ঝুমুর-গবেষকের সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে ঝুমুর গান ও গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।