বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাতর পুরুলিয়ার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে ঝুমুর গান নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় সোহম দাস।

সাক্ষাৎকারে সুনীল মাহাত: ঝুমুর গানের একাল তার ভাব, ভাষা, পুনরুত্থান ও ভবিষ্যৎ

in Interview
Published on:

সোহম দাস (Soham Das)

সোহম দাস আমেরিকান কলেজ-পড়ুয়াদের সাহায্যকারী একটি সংস্থা চেগ আইএনসির ওয়েবসাইটে ভূবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কলা-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে তাঁর বরাবরের আগ্রহ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও ওয়েব ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত নিবন্ধ ও ফিচার লিখে থাকেন। প্রধানত খেলা, ইতিহাস, সিনেমা তাঁর লেখার অন্যতম বিষয়। এছাড়া, বিলগ্ন সাংবাদিক ও অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অনলাইন নলেজ প্ল্যাটফর্ম 'রোর মিডিয়া'র বাংলা বিভাগ 'রোর বাংলা'য় একসময় নিয়মিত লিখতেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই 'তেকাঠি ও তারা খসার গল্প'। তাঁর লেখার ক্ষেত্র মূলত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। কলকাতা দূরদর্শনে তথ্যচিত্র ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখার কাজে যুক্ত আছেন। লেখার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনাও করেন।

বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাতর পুরুলিয়ার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে ঝুমুর গান নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় সোহম দাস।

সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে যাঁর সংস্কৃতি এবং দর্শন কেটেছে এই লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে, সেই মানুষটির সাহচর্যে জেনে নেওয়া গিয়েছিল তাঁর যাত্রাপথের অলি গলি—তাঁর অনুভব, জীবনবোধ এবং শিক্ষানুভূতি।

সোহম দাস: আপনি কুড়মালি ভাষাতে প্রচুর গান লিখেছেন এবং বাংলাতেও প্রচুর লিখেছেন। আপনার কী মনে হয়, বর্তমানে স্থানীয় এবং বৃহত্তর দুটো সমাজেই কুড়মালির কতটা চল রয়েছে? আপনার পরে এই ভাষায় গান লেখা বা শিল্পচর্চা, সেই ধারার ভবিষ্যৎ কী?

সুনীল মাহাত: আমি যেটা আগেও বলেছি, যে, আমরা যেরকম এখানকার পরিবেশকে নেব, যেরকম এখানকার মানুষজনকে নেব, সেরকম এখানকার ভাষা নিয়েও আমরা যদি অরিজিনাল ঝুমুর  আমরা লিখি। যেমন, আমি যখন প্রথম দিকটায় ঝুমুরটা লিখেছি, তখন আমি বাংলাতেই লিখেছি, তারপর মানভূমীতেও লিখেছি। তারপর ধীরে ধীরে কুড়মালির দিকে গেছি। মানে, এটা একটা প্র্যাক্টিস। সেটায় যদি না থাকি, আমি কিন্তু কুড়মালিটা ব্যবহার করতে পারব না। আমার ধারণা যে, এখানকার ভাষা,  সংস্কৃতি,  পরিবেশ,  মানুষজন,  জীবনযাত্রা, এই পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ে আমরা যদি ঝুমুরে যাই, তাহলে আরও সুন্দর হয় জিনিসটা। কুড়মালি ভাষার উপরেও আমরা ফাইট করেছি। আজকে, ঝাড়খণ্ডের চার-পাঁচটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয় কুড়মালি ভাষা। এখানে পশ্চিমবঙ্গেও সিধু-কানুতে (বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ানো হচ্ছে। এরপর হয়ত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হবে, এবং রাজ্য সরকার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে কুড়মালিকে মর্যাদা দেবে। আমরা  এটা অষ্টম তফশিলে কীভাবে  নিয়ে যাওয়া যায়, তার চেষ্টা করছি। আমি কুড়মালিতে রামায়ণ-মহাভারত লিখেছি। এছাড়া, উপন্যাস লিখেছি, গল্প লিখেছি, কবিতা লিখেছি। ঝুমুর গানও প্রচুর লিখেছি। দেখা যাচ্ছে যে, বাংলায় যে ঝুমুর লিখছি সেটা একরকম হচ্ছে, আবার কুড়মালিতে যখন ঝুমুর লিখছি, সেটার ওয়েটটা কিন্তু অনেক বেশি হচ্ছে। সেটা আরও সুন্দর লাগছে। আমি কিছু রবীন্দ্রনাথের গানও কুড়মালিতে ট্রান্সলেট করেছি এবং একটা বইও আমি বের করেছি ’রবিঠাকুরের গান’ বলে। সেগুলো কিন্তু এখন বাঙালি ছেলেমেয়েরা প্রচুর গাইছে। আমাদের এখানে ভাস্কর রায় আছেন, মিহিরদার শিষ্য, সেই ভাস্কর ছ’টা গান গেয়েছে, বাংলা নাটক তার অডিও রেকর্ড করেছে। কুড়মালিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতটা অদ্ভুত সুন্দর হচ্ছে এবং ট্রান্সলেশনটারও অনেকে প্রশংসা করেছে। রবীন্দ্রভারতী কুড়মালিতে আমার দু’টো রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছে। সেটা ইন্দ্রাণী মাহাত রেকর্ড করেছে। তখন , রবীন্দ্রভারতী সাঁওতালি, মুণ্ডারি, ওড়িয়া, অসমিয়া, কুড়মালি এরকম বিভিন্ন ভাষায় রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিল। সেখানে ইন্দ্রাণী যেটা আমাকে বলেছে সেটা হচ্ছে যে, ওখানে সকলে বলেছে কুড়মালি ট্রান্সলেশন বেস্ট  হয়েছে। এটা একটা খুব ভাল অভিজ্ঞতা। কুড়মালি গানের মধ্যে কিন্তু একটা মাটির টান রয়েছে, এবং তার মধ্যে যদি কাব্য করা যায়, কুড়মালিতে যে গানগুলো লেখা হচ্ছে, সেগুলো যদি ঠিকঠাক গাওয়া যায়, সে হবে এক অপূর্ব জিনিস। এটা শুধু কুড়মি বেল্টের ভাষা নয়। পুরুলিয়াতে ঝালদা, সেখান থেকে রাঁচি, এই এলাকাটাতে পুরো কুড়মালি চলে। আবার, পুরুলিয়া থেকে এদিকে (উত্তর-পূর্বে বর্ধমানের দিকে) যেতে গেলে রঘুনাথপুর, পারা, এদিকে কিছু বলে। পুরুলিয়ার যেটা পূর্বদিক, আপটু ঝাড়গ্রাম, মানে মানভূম বেল্টেও আছে। তারপর আবার মালদার দিকেও কুড়মালি আছে। বাংলাদেশেও কুড়মালি আছে। অসমেও যারা আছে, তারাও কিন্তু কুড়মালি বলতে পারে। এই যে বেল্টটা, এই বেল্টের বাইরেও যারা আছে, তারাও কিন্তু কুড়মালিতে অনেক ভাল গাইছে। এটা দেখে ভাল লাগছে। কুড়মালির একটা ভবিষ্যৎ কিন্তু আছে। আমরা দেখেছি, আমাদের এখানকার যা করম গীত আছে, বা অহিরা-বাঁদনা গীত আছে, বা প্রচুর ঝুমুর গান আছে, সেগুলো কিন্তু কুড়মালি ভাষাতে ছিল এবং এখনও সেটা চালু আছে। যদি ঝাড়গ্রামে যাওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, কুড়মালিতেও গাইছে তারা। অরিজিনাল ব্যাপারটা কিন্তু ওখান থেকে আসতে পারে, এবং, কুড়মালির যে স্টক অফ ওয়ার্ডস আছে, অনেক সময় সেটা আমরা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছি না, কারণ এটা তো আনরিটেন এখনও। আমি যেমন এখানে একটা উপন্যাস লিখেছি, ’দহনডালে’। এখানের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে উপন্যাসটা, অসমে কীভাবে চালান হয়েছে এখানকার লোকগুলো, সেইসব বিষয়ে। এক্ষেত্রে কিন্তু আমি বাংলাতে সেই এক্সপ্রেশনটা আনতে পারব না।

সো. দা.: আমরা অনেকেই বলি এবং এটা আমরা শুনেও থাকি যে, বাউল গানের দীর্ঘ সময় ধরে যে একটা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা, সেটার পিছনে রবীন্দ্রনাথের এক বিরাট অবদান।  মানে, রবীন্দ্রনাথের জন্যই বাউল গানটা অনেকটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন। সেটার কতটা সত্যতা, তার গভীরে আমি এখন যাচ্ছি না। কিন্তু, আপনার কি মনে হয় যে, ঝুমুরের ক্ষেত্রে সেইরকম কেউ থাকলে ঝুমুরও কি সেই জায়গায় যেতে পারত?

সু. মা.: আমি শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ, তখনকার যেসব ঝুমুর শিল্পীরা ছিলেন, যেমন, রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি, বা আরও দু-একজনের সঙ্গে নাকি গল্প করেছিলেন। ডেকেওছিলেন হয়ত শান্তিনিকেতনে। এঁদের সঙ্গে গল্প করার পর  উনি যে কোনও কারণেই হোক, ঝুমুরের উপর কাজটা করেননি। এটা নাকি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, ঝুমুরটা আমি করছি না, ওটা তোমরাই করো। আমি সঠিক জানি না। তবে হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের মতো কেউ যদি হত, তাহলে  আন্তর্জাতিক ভাবে ঝুমুরকে তুলে ধরার একটা বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হত। , যেমন, এখন ঝুমুর গান আমি দেখছি যে, আমাদের যারা শিল্পীরা আছে, তারা মাঠে-ময়দানে গায়। তারা তো পরিবেশন করার যে কৌশল, বা সেভাবে নিজেকে তৈরি করা, এখন এই যে সাউন্ড সিস্টেম, তাকে ব্যবহার করা, অডিও রেকর্ডিং করা, বা ভিস্যুয়াল ভিডিও করার যে ব্যাপারগুলো, এই টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো জানে না। আমরা দেখেছি, প্র্যাক্টিক্যালি নাচনিরা যখন নাচছে, তখন মাইক্রোফোন ছিল না, তাদের খুব উচ্চগ্রামে গাইতে হত এবং নেচে নেচে তারা গানটা গাইত। নেচে নেচে গানটা পরিবেশন করার ফলে কী হত, গলাটা ভেঙে যেত। এমনিতে শুনতে ভালই লাগত, কিন্তু যখন রেকর্ডিংয়ে যাচ্ছে, তখন কিন্তু গলার সেই মাধুর্যটা থাকছে না। আরও যে টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো আছে, যেমন, এখানে যারা গান গাইছে, তারা প্রচুর পরিশ্রম করে। এই পরিশ্রম করার ফলে চেস্টে এক্সারসাইজ হয়, সেজন্য গলাটা অনেকটা রাফ হয়ে যায়। কিন্তু যারা ভাল সিঙ্গার, তারা তো ওইরকম পরিশ্রমটা করে না। গলাটাকে তারা বাঁচাতে পারে, গলাটাকে তারা তৈরি করে। অডিও  সিস্টেমটাকে তারা ব্যবহার করতে জানে। আমি এখানকার শিল্পীদের অনেকেরই গান রেকর্ড করেছি। দেখেছি, এই অডিও সিস্টেমটাকে তারা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছে না। এমনি মাঠে-ময়দানে ওরা খুব সুন্দর পরিবেশন করছে। কিন্তু গলার যে মাধুর্য, সেটাকে বজায় রাখতে গেলে যে ধরনের অনুশীলন, যে ধরনের রেস্ট্রিকশনে থাকা দরকার, তার মধ্যে থাকতে পারছে না। সেখানে যদি আজকে লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, কিশোর কুমারের মতো লোক গাইতেন, তাহলে তো ঝুমুর অনেক আগেই পপুলার হয়ে যেত।

সো. দা.: এঁদের মতো ব্যক্তিত্বদের কাছে ঝুমুরটা যে পৌঁছল না, সেই কারণটা আপনার কী মনে হয়? ওঁরা যেসময় ধরুন একদম পিক ফর্মে, ওই সিক্সটিজ-সেভেন্টিজ এই সময়ে, ওই সময় তো আপনি বলছেন, ঝুমুরকে ঘৃণার চোখেই দেখত সাধারণ মানুষ। সেইটাই কি কারণ?

সু. মা.: হ্যাঁ, সেইটাই কারণ। অ্যাভয়েড করেছেন। ঝুমুর কিন্তু তেমন প্রতিভাবান লোকেও গেয়েছেন। যেমন, কমলা ঝরিয়া কিন্তু ঝুমুর আর্টিস্ট। ঝরিয়া মানে আমাদের এখানে যে ঝরিয়া-ধানবাদ আছে, এই মানভূমের মধ্যেই…

সো. দা.: কোলিয়ারি বেল্ট…

সু. মা.: হ্যাঁ, কোলিয়ারি বেল্টে। সেখানে রাস্তায় ওঁকে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল। রাস্তায় গান গাইতেন। যেমন, আজকে রানু মণ্ডলকে নিয়ে গেল, সেরকম ওখান থেকে কোনও বাংলা সিনেমার লোকই নিয়ে গিয়েছিল কমলা ঝরিয়াকে।  তাঁর গলা সুন্দর ছিল। কমলা ঝরিয়া পরবর্তীকালে কীর্তনও পরিবেশন করেছেন। কিন্তু ঠিকঠাক ভাবে ঝুমুরের ফোকাসিং হয়নি এবং ঝুমুর গানটাকে আমরা যে ব্যবহার করতে পারব এই বাংলা সিনেমাতে, বা রেকর্ডিং করে সেটাকে পরিবেশন করতে পারব, এই ধারণাটা কেন হয়নি, কে জানে! কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। এখন যেমন শিলাজিৎ গাইছে, অভিজিৎবাবু মানে অভিজিৎ বসু গাইছেন, দোলা রায় গাইছে আমার গান, এরকম কলকাতার শিল্পীরা অনেকেই গাইছে। ঝুমুর ন্যাচারালি পপুলার হয়ে গেছে। যত ভাল শিল্পী গাইবে, পরিবেশনটাও তত ভাল হবে।

সো. দা.: বর্তমান যারা ঝুমুর-শিক্ষার্থী, তাদের মধ্যে, আপনি বলছিলেন, কিছু কিছু মানুষের খুবই আগ্রহ রয়েছে ঝুমুরের প্রতি। এই আগ্রহটা কি এখন যেরকম ঝুমুর লেখা হচ্ছে তার প্রতি, নাকি, আদিযুগে বা মধ্যযুগে যেরকম ঝুমুর লেখা হয়েছে, তার প্রতিও এই আগ্রহটা সমান?

সু. মা.: আমরা এই সবে একটা পরিবেশ তৈরি করে এটা বোঝাতে পেরেছি যে, ঝুমুরটা একটা ভাল জিনিস। ঝুমুরের মধ্যে আমরা যেরকম আমাদের কথা বলতে পারি, সেরকম রাধা-কৃষ্ণের কথাও বলতে পারি, দেহতত্ত্বের কথাও বলতে পারি। ঝুমুরটা যে কোনও খারাপ জিনিস নয়, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেটা মানুষ বুঝেছে। একটা জিনিস আজকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এখানকার শিল্পীরা যদি নিজেদের তুলে ধরতে চায়, তাহলে সেটা ঝুমুরের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারবে। এরা তো রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নজরুল-গীতি ভাল গাইতে পারবে না, এমনকি, আধুনিক গানও ভাল গাইতে পারবে না, আমাদের পরিবেশের মধ্যে ওটা নেই এখনও। যেটা রক্তে আছে, সেটা  এরা ভাল করতে পারবে। সেটা সকলে বুঝতে পেরেছে। আগ্রহটা বেড়েছে সেই কারণেই। যেমন, এখানকার ছৌ শিল্পীরা, এরা কিন্তু ছৌ নেচেই গোটা পৃথিবী জয় করতে পারে। এরা কিন্তু ভারতনাট্যম দিয়ে পারবে না। সেই পরিবেশটা তো এরা পাচ্ছে না।সেখানে, আমাদের যারা গ্রামের শিল্পী, তারা তো ঝুমুর গানের পরিবেশে মানুষ হচ্ছে এবং এরা খুব সহজেই এটা করতে পারছে। সেইজন্যে ঝুমুর গানের উপর আগ্রহটা এখন বেড়েছে।

সো. দা.: এদের ঝোঁকটা কি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক গানের দিকে, না, এখনকার জীবনযাত্রা নিয়ে যে গান, তার দিকে?

সু. মা.: সবটাই আছে। এরা রাধাকৃষ্ণ বিষয়েও গান গাইছে, কিন্তু ম্যাক্সিমাম গাইছে লোকাল যে থিমটা নিয়ে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ে, নিজেদের কথাগুলো যে গানগুলোতে আসছে, সেগুলো নিয়ে।

সো. দা.: আপনি অনেক বছর ধরে ঝুমুরের গবেষণা করছেন, দীর্ঘ সাড়ে চার দশক। আগামী প্রজন্মে যেসব শিল্পীরা আসবে, বা, বর্তমান যে প্রজন্ম আছে ঝুমুর শিল্পীদের, তারা ভবিষ্যতে কী করতে পারে, মানে, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের করণীয় কী, সেই বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

সু. মা.: আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে এটা নিয়ে চর্চা করলাম। এটাকে কীভাবে নতুনভাবে গঠন করা যায়, সেই ব্যাপারটা আমরা দেখলাম। আগেকার যে দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল সেটাকে আমরা চেঞ্জ করে দিয়েছি। পরিবর্তন একটা এসেছে। এবং, আমাদের গ্রামীণ শিল্পী বলুন বা, সমাজের অন্যান্য যেসব ছেলেমেয়েরা গাইছে, একটা প্রয়োগ তৈরি হয়েছে। আমাদের যে ঝুমুর গান, বা অন্যান্য যে লোকসঙ্গীত আছে, সেগুলোকে নতুন করে নিয়ে আমরা চর্চা করতে পারি, সেটা পরিবেশন করাটা ভাল। এটা অনেকেই বুঝেছে, এবং আগ্রহটা প্রচুর তৈরি হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, গ্রামীণ পরিবেশে পরিবেশন করা এবং সেটাকে অডিও-ভিস্যুয়ালি  একটা ওয়াইড সার্কুলেশনে নিয়ে যাওয়া, এই দুটোর মধ্যে অনেক তফাত আছে।  যেমন, তাকে গলাটা তৈরি করতে হবে, তার মিউজিক্যাল সেন্সটা দরকার, এই ব্যাপারটাকে তাকে হজম করতে হবে। গ্রামে পরিবেশনের ধরন অনেক আলাদা, সেখানে সফিস্টিকেটেড কোনও শ্রোতা নেই। যেমন-তেমন করে পরিবেশন করা যায়। কিন্তু ওটা যখন আমি বৃহত্তর জায়গায় নিয়ে যাব, তখন কিন্তু আমাকে তৈরি হতে হবে। সেই তৈরি করার জায়গাটা দরকার। সেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা তৈরি হচ্ছে। যে অবহেলাটা ছিল, যে ঝুমুর ওই ব্রাত্যজনের গান, ছৌ নাচ মানে সে বাগালজনের নাচ, এই ধারণাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন কিন্তু, ঝুমুর গান পরিবেশন করতে গিয়ে কারও মনে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সটা আসছে না। শহরের প্রচুর ছেলেমেয়ে এখন ঝুমুর গান গাইছে। অ্যাকাডেমিক  স্বীকৃতিটাও আসছে। যেমন, আজকে সিধু-কানু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুমুর গান পড়ানো হচ্ছে, ছৌ নাচ পড়ানো হচ্ছে। তার ফলে, একটা পরিবেশ কিন্তু তারা পেয়ে গিয়েছে। এখন এটাকে ঠিকঠাক ইউটিলাইজ করতে হবে, এবং এখানকার শিল্পীরা যদি সেটা করতে পারে, তাহলে সবথেকে ভাল হয়। কারণ, এখানকার শিল্পীরা পরিবেশটা জানছে, টোটাল ব্যাপারটা অঙ্গাঙ্গিভাবে তার মধ্যে আসছে। সেটার সঙ্গে যদি অ্যাকাডেমিক ব্যাপারটা থাকে, শিক্ষাটা থাকে, অর্থাৎ, ঝুমুর সঙ্গীতের যে প্রথাগত শিক্ষা, সেটা যদি থাকে, তাহলে আরও অনেক ভাল হয়। অনেক ভালভাবে পরিবেশন করা যাবে।

সো. দা.: ঝুমুর শিল্পীদের কথা তো হল, এবার ঝুমুর গবেষণা যাঁরা করছেন, তাঁরাও মনে হয়, সমানভাবে জরুরী ঝুমুরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তাঁদের গবেষণার ধারাটা আপনি কীরকম দেখছেন? তাঁরা কতটা গভীরভাবে গবেষণাটা করতে আগ্রহী? বাইরে থেকে যাঁরা গবেষণা করতে আসছেন, তাঁদের সম্পর্কে আপনার কী মতামত?

সু. মা.: একটা জিনিস হল, গবেষণা দু’ধরনের হয়। এক হল, গবেষণার জন্য গবেষণা। মানে, ডিগ্রির জন্য আমার একটা গবেষণা দরকার। সেটা আলাদা। এবং একটা, আন্তরিক ভাবে গবেষণা। সেটা হল, টোটাল একটা ব্যাপারকে বুঝে, তার প্রবলেমগুলো বুঝে এবং টোটাল জিনিসটাকে নিয়ে। এই যে আমরা যেমন করছি, আমরা তো কোনও ডিগ্রির জন্য গবেষণা করিনি। আমি একসময় রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম রাঁচিতে, পিএইচডি করার জন্যে। কিন্তু আমি সেটা করিনি। কারণ, আমি প্রথমেই বলেছি, আমি অর্থোডক্স গবেষণাটা চাই না। ক্রিয়েটিভ রিসার্চ, বা সৃজনমূলক গবেষণা যেটাকে বলা যায়, সেটা আমি করেছি। এটাকে ডেভেলপমেন্ট কীভাবে করা যায়, সেই গবেষণাটা আমি করেছি। আমি তো কোনও ডিগ্রির জন্য গবেষণাটা করছি না। এরকম যাঁরা গবেষণা করবেন, আন্তরিক ভাবে যদি সেই গবেষণাটা হয়, তাহলে কিন্তু ভাল হয়। তাহলে এটা আমাদেরও কাজে লাগে, শিল্পটার ক্ষেত্রেও কাজে লাগে।

সো. দা.: তাঁরা কি আপনাদের কাছে পৌঁছচ্ছেন?

সু. মা.: অনেকেই পৌঁছচ্ছেন, আবার অনেকেই দায়সারাভাবে এটা করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যেটা আমরা চাই, অন্তত যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁরা এটার উপরে কাজ করুন। তাহলে এই শিল্পমাধ্যমটার অনেক ডেভেলপমেন্ট হবে। এটার যে ডেফিসিয়েন্সিগুলো, সেগুলোকে যদি তাঁরা তুলে ধরেন বা যদি এটা রিয়্যালাইজ করেন, যে, এটাকে আরও কীকরে স্ট্রং করা যায়, মজবুত করা যায়, সেই ব্যাপারটা যদি তাঁরা অ্যাডভাইজ দেন গবেষণার মাধ্যমে, তাহলে সেটা আরও ভাল হয়।

সো. দা.: এই যে আপনি সিধু-কানু বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললেন, যে, ওখানে ঝুমুরের কোর্স শুরু হয়েছে, এরকম কিছু কাজ সেখানে হচ্ছে, সেখানে অবস্থা কীরকম? সেটার ভবিষ্যৎ কী?

সু. মা.: সব কিছুর মতোই এটাও শুরুতে একটু ঢিলেঢালা আছে। কোথা থেকে শুরু করব, কোথায় গিয়ে শেষ করব, এটার কোনও সিস্টেম তো এখনও তৈরি হয়নি। এটার একটা পোস্ট ঠিকঠাক তৈরি হয়নি। এটা জাস্ট একটা পরীক্ষামূলক ভাবে চলছে। একটা কোর্স অফ স্টাডি বানাতে হবে। এখনও সেই জায়গাটাতে আসেনি, সদ্য একবছর হয়েছে। যেমন, ছৌয়ের কিছু গ্রামার আছে। আমি একটা ছৌ ওয়ার্কশপ করেছিলাম। আরও গোটাকতক ওয়ার্কশপ করেছি। সেই ওয়ার্কশপের মধ্যে আমি ছৌয়ের কিছু মুদ্রা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এমন চৌষট্টিটা মুদ্রা আমি বার করেছিলাম। মানে, সেটাকে যদি অনুশীলন করা যায়, ছৌ অটোমেটিক্যালি আসবে। সেরকম ঝুমুরের ক্ষেত্রে এটা যদি আমরা করি, যে নতুন ভাবে পরিবেশনার ক্ষেত্রে এটাকে আরও কীভাবে স্ট্রং করা যায়, সেই ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে উঠে আসবে। এখনও সেটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গল কুড়মি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কালচারাল বোর্ড আছে। আমি তার চেয়ারম্যান। কুড়মালি ঝুমুরের উপর আমরা একটা ক্লাস করছি । এখানে এখনও এটা যে কীভাবে হবে, সেই স্ট্রাকচারটাও এখনও তৈরি হয়নি। সেটাকে আমাকে খুঁজে খুঁজে বার করতে হবে, যে কীভাবে আমরা এগোব। ঝুমুরের ক্লাস হচ্ছে মানে কেউ আসছে, গাইল, কী কিছু করল, তা করলে তো হবে না। অনেক টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে। আমি একবার এটা আলোচনা করেছিলাম, তখন মিহির দা বেঁচেছিলেন, সলাবত দা ছিলেন (কিংবদন্তি ঝুমুর শিল্পী সলাবত মাহাত), অমূল্য দা (শিল্পী অমূল্য কুমার) তো এখনও আছেন, -এঁদের সঙ্গে যে, ঝুমুরের পরিবেশনার ক্ষেত্রে  কী করা উচিত। । যেমন, নাচনিরা আগে পরিবেশন করত। সেখানে একজন মেয়ে নাচছে, সঙ্গে গানটাও গাইছে। সেটা আকর্ষণীয় হচ্ছে। কিন্তু নাচনি সিস্টেমটা প্রায় শেষের দিকে। সেভাবে তৈরি হচ্ছে না নাচনিরা। এখন আমাদের যারা পরিবেশন করছে ঝুমুর, তারা এমনি বৈঠকী ঝুমুর যেটাকে বলা যায়, তার স্টেজ পারফরম্যান্স করছে। সেটা ছেলে হতে পারে, মেয়েও হতে পারে। কিন্তু সে তো নেচে নেচে পরিবেশনটা করছে না। সে মূলত গেয়ে পরিবেশন করছে। নেচে যে পরিবেশন করা, তার অ্যাট্রাকশনটা আলাদা। এখানে দেখা যাচ্ছে, একটা ঝুমুর, দশ মিনিট , কুড়ি মিনিট ধরে একটা মেয়ে গাইছে। অথচ মেয়েটা যখন নাচছে, তখন দর্শক অ্যাক্সেপ্ট করছে। কিন্তু  একটা ঝুমুর আমি যদি পরিবেশন করি একটানা বসে বসে, সেটা কি অ্যাক্সেপ্ট করবে কেউ? করবে না। এখানে এই যে গ্যাপটা, এই যে নাচের সময় অনেকক্ষণ ধরে বাজনাটা বাজছে, এটা পরিবেশনের ক্ষেত্রেও আমি যদি করি, তাহলে তো শুনবে না লোকে। এইখানেই গ্যাপটা হচ্ছে। দরবারি ঝুমুরে আমরা দেখেছি, একটা গান গাইল, একটা স্টেজে গাইল, যেকোনও একটা গান, প্রথমটা খুব ধীর লয়ে সে ধরল,এরপর বাজনাটা শুরু হল, মেয়েটা নাচছে, সেটা লোকে দেখছে। কিন্তু যখন বৈঠকী আসরে আমি নিজে পারফর্ম করছি, তখন ওই গ্যাপটার কী হবে? দরবারি ঝুমুরের ক্ষেত্রে এই রীতিটা কিন্তু এখনও আছে। যখন ও গাইছে, ওই বাজনাটা অনেকক্ষণ ধরে চলছে। এটা কিন্তু দর্শক অ্যাক্সেপ্ট করছে না। আমি এটা মিহিরদাদের বলেছিলাম। বাজনাটার ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, সেটা হল, প্রথমে ধীরে ধীরে শুরু করে খুব দ্রুত লয়ে যাচ্ছে, তারপর শেষ হয়ে যাচ্ছে, আবার সে একটা খুব ধীর পয়ার শুরু করে দিল। এটা যখন আমরা রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে যাচ্ছি, তখন ওই বাজনার এখানে একটা বিশাল বড় গ্যাপ থাকছে। এই ভ্যাকুয়ামটা কীভাবে পূরণ করা যাবে! একটা রিদমে যখন একটা গান চলে গেল, সেই রিদমটাতেই তো তাকে শেষ করতে হবে। এখানে যেটা হচ্ছে, রিদমটা একবার তুঙ্গে উঠে যাচ্ছে, তারপর ওটাকে বন্ধ করে সেই ধীর লয়ে শুরু করতে হচ্ছে। ওটা হবে না, একটা একক রিদমে আসতে হবে। এই ব্যবহারিক ব্যাপারগুলোকে ঠিক করতে হবে। সেটার একটা সলিউশনও এখানে আছে, সেটা আমি দেখিয়েওছি। ঝুমুরের বিভিন্ন স্টাইল আছে, যেমন ছোটনাগপুরে নাগপুরিয়া স্টাইল আছে, রাঁচির দিকে, এখানে পাঁচপরগণা এলাকায় পাঁচপরগণা স্টাইল আছে, তামাড় এলাকায় তামুড়িয়া স্টাইল আছে, গোলা এলাকায় গোলওয়াড়ি স্টাইল আছে, এখানে মানভূমিয়া স্টাইল আছে, বরাভূমিয়া স্টাইল আছে, সিকড়িয়া স্টাইল আছে।এই যে বিভিন্ন স্টাইলের ঝুমুর, তার মধ্যে আমি দেখেছি, বাঘমুণ্ডি স্টাইল, তার মধ্যে কোনও গ্যাপ নেই। একটা রিদমেই গানটা শুরু হচ্ছে, একটা রিদমেই গানটা শেষ হচ্ছে। এই জায়গাটা ভাবতে হবে যে, পরিবেশনার ক্ষেত্রে ঝুমুর গানটাকে কীভাবে আমরা পপুলার করতে পারব এবং দর্শক কেন নেবে এটা।

সো. দা.: যেহেতু নাচনি প্রথাটা শেষ হয়ে আসছে, সেহেতু বৈঠকী দিয়েই চালাতে হবে…

সু. মা.: নাচনিরা যেহেতু আর নেই, এখন বৈঠকী দিয়েই চালাতে হবে। এখন যারা ঝুমুরের ধারক-বাহক হবে, তারা কিন্তু নাচনি নয়। তারা শিল্পী হিসেবেই সেখানে আছে, অন্য কিছু কারিকুরি করার জায়গা নেই। তাকে গলা দিয়েই, কণ্ঠ-মাধুর্য দিয়েই এবং সাঙ্গিতিক যে ব্যাপারগুলো আছে, সেগুলো দিয়েই পরিবেশন করতে হবে এবং মানুষের মন জয় করতে হবে।

সো. দা.: ঝুমুরে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে?

সু. মা.: আধুনিক বাদ্যযন্ত্র যেটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে, সেটা ব্যবহৃত হতেই পারে। ঢোল-ধামসা আগে ছিল।এখন, ঢোল-ধামসা-মাদল-সানাই, এই কম্বিনেশনটাকেও আমরা ব্যবহার করতে পারি। এছাড়া, আধুনিক ঝুমুরে আমরা যেমন হারমোনিয়াম, ফ্লুট, কর্নেট এসব ব্যবহার করেছি। তবলার ব্যবহার হচ্ছে। হারমোনিয়াম আগে ব্যবহৃত হত না, এখন হচ্ছে। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র আমরা ব্যবহার করতেই পারি, কিন্তু কোনটা আমাদের ক্ষেত্রে স্যুটেবল, সেটা দেখতে হবে। যেমন, সাঁওতালি গানের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কেঁদরিটা খুব স্যুটেবল। অনিল ক্যুইলা বলে একজন শিল্পী ছিলেন, রেডিওতে গাইতেন, উনি একটা নতুন হারমোনিয়ামই তৈরি করেছিলেন, সাঁওতালি গানের জন্যে। কোনটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ইন্সট্রুমেন্ট নিতে হবে।  অনেক ফরেন ইন্সট্রুমেন্টও নিতে পারি। দোতারাটা আমরা নিতে পারি। দোতারাটা এখানে ব্যবহৃত হয় না। একতারা নিতে পারি। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হচ্ছে কিনা, সেটাই দেখতে হবে।