রাঢ়বঙ্গের ঝুমুর: একটি সার্বিক মূল্যায়ন

in Overview
Published on: 07 August 2020

সোহম দাস (Soham Das)

সোহম দাস আমেরিকান কলেজ-পড়ুয়াদের সাহায্যকারী একটি সংস্থা চেগ আইএনসির ওয়েবসাইটে ভূবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কলা-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে তাঁর বরাবরের আগ্রহ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও ওয়েব ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত নিবন্ধ ও ফিচার লিখে থাকেন। প্রধানত খেলা, ইতিহাস, সিনেমা তাঁর লেখার অন্যতম বিষয়। এছাড়া, বিলগ্ন সাংবাদিক ও অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অনলাইন নলেজ প্ল্যাটফর্ম 'রোর মিডিয়া'র বাংলা বিভাগ 'রোর বাংলা'য় একসময় নিয়মিত লিখতেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই 'তেকাঠি ও তারা খসার গল্প'। তাঁর লেখার ক্ষেত্র মূলত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। কলকাতা দূরদর্শনে তথ্যচিত্র ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখার কাজে যুক্ত আছেন। লেখার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনাও করেন।

ভূমিকা

বাংলা তথা ভারতের মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে পূর্ব ভারতের পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ পাথুরে ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলটি, যাকে আমরা মূলত চিনি ‘রাঢ়ভূমি’ নামে। লালচে কালো মাটির এই দেশের রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি, শাল-পিয়াল-মহুয়ার  গহন সজীবতা, অজস্র ছোট ছোট টিলা-পাহাড়ের  মায়া ভরা হাতছা্নি—এ-সব নিয়ে রাঢ় যেন বড় স্বতন্ত্র। (চিত্র ১) তবে শুধু এই প্রাকৃতিক কাঠিন্যই নই, এই পাহাড়-অরণ্যের দেশের একান্ত আপন সংস্কৃতিও যেন সেই স্বাতন্ত্র্যকে প্রতি মুহূর্তে আরও পুষ্ট করেছে। কাঁকুরে মালভূমির এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল, ফাঁকা টাঁড়, জঙ্গলের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা অসংখ্য গ্রাম, সেই গ্রামের মাটির মানুষেরা, বিভিন্ন জনজাতি, তাদের  বিচিত্র  জীবনযাত্রার ধরন, সবই যেন মিলেমিশে থাকে একসঙ্গে।

চিত্র ১. রুক্ষ রাঢ়ভূমির ছবি। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ১. রুক্ষ রাঢ়ভূমির ছবি। (সৌজন্যে: সোহম দাস)

মানিকলাল সিংহ তাঁর পশ্চিম রাঢ় তথা বাঁকুড়া সংস্কৃতি গ্রন্থে লিখছেন—“ছোটনাগপুর মালভূমির কণ্ঠলগ্ন ধলভূম, সিংভূম, শবরভূম, বরাহভূম, শিখরভূম, তুঙ্গভূমের বাহুবেষ্টনীর মধ্যে দক্ষিণ রাঢ় আর সাঁওতাল পরগনার অঙ্কশায়ী উত্তর রাঢ় সুপ্রাচীন জনপদ। রুক্ষ এর প্রকৃতি, রূঢ় এর পরিবেশ। তরঙ্গায়িত এই ভূমি পত্রপতনশীল শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়াল, আবলুসের নিবিড় বনানীর শ্যাম-আলিঙ্গনে দৃঢ়বদ্ধ। খেয়ালী নদনদীর কলকল স্বর আর খলখল হাসিতে উচ্ছল। এই রুক্ষ রূঢ় প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত রাঢ়ের আদিম সন্তানদের জীবনের বিচিত্র লীলা-সংস্কৃতির সহজ বিকাশ, কলভাষার মন্থর প্রকাশ।”[1]

পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র পুরুলিয়া, বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলা এবং দুই বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার কিয়দংশে বৈচিত্র্যময় এই রাঢ়ভূমির বিস্তার। বঙ্গের অংশ বলে এই অঞ্চলটিকে সাধারণত রাঢ়বঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়। নানাপ্রকার লোকনৃত্য যেমন ছৌ নাচ, কাঠি নাচ, বুলবুলি নাচ, নাচনি নাচ, দাসাই নাচ এবং বিভিন্ন লোকসঙ্গীত যেমন টুসু গান, ঝুমুর গান, ভাদু গান, বাউল গান, সোহরায় গান, বছরভর নানা আনন্দ-বিষাদের উৎসব, পরব, পুজো-পার্বণ এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। উদযাপিত হয় বিভিন্ন পরব, সেই পরব উপলক্ষ্যে নানা গ্রামে বসে মেলা। সেই মেলায় জলসা অনুষ্ঠান থেকে মোরগ লড়াই, ফুটবল ম্যাচ সবই থাকে। (চিত্র ২) তবে রাঢ় সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, প্রতিটি উৎসব বা প্রতিটি নাচ-গানই একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । যেমন, টুসু ধ্বনির বিসর্জনে যে গান গাওয়া হয়, সে হল ঝুমুর গান। আবার ছৌ নাচে যে ধরনের গান গাওয়া হয়, সেই গানের সুর মূলত হয় ঝুমুরেরই। (চিত্র ৩) নাচনি শিল্পীরাও ঝুমুর গানের তালে তালেই তাঁদের নাচ প্রদর্শন করেন। তাই একথা খুব স্পষ্ট যে, এই অগণিত নৃত্য ও সঙ্গীতকলার মধ্যে বহুল প্রচলিত সঙ্গীতকলাটির নাম ঝুমুর। রাঢ়ের এক সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে এর বিস্তার, বছরের প্রায় অধিকাংশ সময়ে এই গান গাওয়া হয়। ঋতুভেদে ও দৈনন্দিন কাজের ধরন ভেদে গানের কথা ও সুরের বদল ঘটে।

চিত্র ২. পৌষ সংক্রান্তির মেলায় মোরগ লড়াই দেখতে মানুষের ভিড়। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ২. পৌষ সংক্রান্তির মেলায় মোরগ লড়াই দেখতে মানুষের ভিড়। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৩. ছৌ নাচের অনুষ্ঠান। এই নাচে যে ধরনের গান গাওয়া হয়, সেই গানের সুর মূলত হয় ঝুমুরেরই। ছবি সৌজন্যে: শুভদীপ চক্রবর্তী। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৩. ছৌ নাচের অনুষ্ঠান। এই নাচে যে ধরনের গান গাওয়া হয়, সেই গানের সুর মূলত হয় ঝুমুরেরই। (সৌজন্যে: শুভদীপ চক্রবর্তী)

ঝুমুর গান: তার বিস্তার, উৎপত্তি, গঠন ও প্রকারভেদ
ঝুমুর গান কী, তা বলার আগে এই সঙ্গীতের সীমানা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। সাধারণ মতে, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর (মূলত পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম), বীরভূম, ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, ধানবাদ, বোকারো, সাঁওতাল পরগনা, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝাড়, সুন্দরগড়, সম্বলপুর অঞ্চলে এই গান প্রচলিত। গবেষক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য আবার বলেছেন,‘ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া সমগ্র মধ্য ভারত ব্যাপিয়া গুজরাটের সীমা পর্যন্ত যে আদিবাসী সংগীত প্রচলিত আছে, তাহা ঝুমুর নামে পরিচিত।’[2] ডঃ মিতা ঘোষ বক্সিও তাঁর পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি বইতে একই মত পোষণ করেছেন। এই তথ্য থেকেই প্রমাণিত হয়, ঝুমুর আসলে কত অগুন্তি মানুষের জীবনে উষ্ণ রক্তস্রোতের মতো, ঝুমুরের সুর আসলে কীভাবে মিশে আছে তাদের প্রতিটা নিঃশ্বাসে। তাঁর মতে“সমাজ ও সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান, অবসর বিনোদন, প্রেম বিরহ, আশা নিরাশা, শিল্প ও সৃজন, কৃত ও কীর্তি, ভাব বিনিময়, সংগ্রাম ও প্রতিবাদে ঝুমুরই তাদের উপায় অবলম্বন হাতিয়ার ও লোকমাধ্যম বলা যায়।”[3]

এবার আলোচনা করা যাক ‘ঝুমুর’ শব্দের উৎস বিষয়ে।  অঞ্চলভেদে ‘ঝুমুর’ শব্দটির উচ্চারণে রকমফের দেখা যায়। যেমন, আমরা, যারা রাঢ়ী বাংলায় (এই রাঢ়ী উপভাষা অবশ্য আলোচ্য রাঢ়ভূমির মধ্যেই আবদ্ধ নয়। গাঙ্গেয় বঙ্গের মানুষজন যে ভাষায় কথা বলেন, সেই বাংলাকেই রাঢ়ী উপভাষা বলা হয়। বরং পুরুলিয়ার বিভিন্ন জনজাতি যে বাংলায় কথা বলেন, তা অনেকাংশেই ঝাড়খণ্ডী উপভাষা-ঘেঁষা।) কথা বলি, তাদের কাছে এই উচ্চারণ ‘ঝুমুর’। আবার পুরুলিয়ার আঞ্চলিক উচ্চারণ ‘ঝুমেইর’ বা ‘ঝুমইর’। ওড়িশায় ‘ঝুমুর’ উচ্চারণই প্রচলিত। এছাড়া, কুড়মালি প্রাচীন গীতে ‘ঝুমরি’ শব্দেরও ব্যবহার রয়েছে। শ্রীখণ্ডের দামোদর মিশ্র  রচিত বৈষ্ণব পদাবলী ‘সঙ্গীত দামোদর’  থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক—“প্রায় শৃঙ্গার বহুলা মাধ্বীক মধুরামৃদু,/একৈব ঝুমুরিলোকে বর্ণীদিনিয়মো দ্বিতা।” (অর্থ: ঝুমুরি বা ঝুমুর গান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শৃঙ্গারবহুল হয়। মধুজাত সুরার মতো তা মধুর এবং মৃদু। এর মধ্যে ছন্দের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম থাকে না।)[4] এই শৃঙ্গার-বিষয়ক রসের জন্য ঝুমুর গান অশ্লীল এবং এই গান যারা পরিবেশন করে, তারাও আসলে নিম্ন শ্রেণির মহিলা। বলাই বাহুল্য, এই বর্ণনা চূড়ান্তভাবে শহুরে একমুখিতার দ্বারা পরিচালিত, যেখানে একটি প্রাচীন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের নিম্ন শ্রেণির বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, এবং সেই চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভাবেই তথাকথিত সভ্য ও শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

পদকল্পতরুর পদে রয়েছে,“যুবতী যুথ শত গায়ত ঝুমরী।” (অর্থ: যুবতী মেয়েরা একসঙ্গে যে গান পরিবেশন করে, তাই হল ঝুমুর বা ঝুমরী)। ‘ঝুমরি’ বা ‘ঝুমরী’-র উল্লেখ পাওয়া যায় মহাপ্রভুর আবির্ভাবের আগে বিদ্যাপতি (“গওই সহি লোরি ঝুমরি সঅন-আরাধনে যাঞা।”) এবং গোবিন্দদাসের পদেও (“মদনমোহন হরি মাতল মনসিজ যুবতী যুথ গাওত ঝুমরী।”)।[5]

অন্যদিকে, আশুতোষ ভট্টাচার্য এই গানকে সাঁওতাল জাতির গান বলে উল্লেখ করেছেন।

বরেণ্য ভাষাবিদ আচার্য সুকুমার সেনের মতে, ঝুমুর আসলে ছিল নাট-গীতের একটি ধারা। নাট-গীতি পালায় মূলত কোনও গদ্য সংলাপ ব্যবহৃত হয় না, সমস্তটাই গান ব্যবহার করে অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন মৈথিলীতেও ঝুমুর শব্দের প্রচলন ছিল বলে সুকুমার সেন জানিয়েছেন। সংস্কৃতে এই গানের নাম ছিল জম্ভালিকা।[6] কিন্তু ‘ঝুমুর’ শব্দের প্রকৃত অর্থ কী? এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই মানভূম তথা পুরুলিয়ারই বিশিষ্ট কবি ও প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী সলাবত মাহাত বলেছেন,- ‘ঝুমুর কথার অর্থ ঝুরে মরা। সুর ও সঙ্গীতের অন্তরের নিবেদনই ঝুমুরের মূল তাৎপর্য।’ আবার কেউ কেউ বলেন, নাচনির ঘুঙুরের ঝুমঝুম শব্দ থেকেই নাকি ঝুমুরের উৎপত্তি।[7]

তবে ঝুমুরের চরিত্র-মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে ডঃ সুধীরকুমার করণ যা বলেছেন, তা একেবারে একশো ভাগ খাঁটি। তাঁর কথায়,‘ঝুমুর শব্দটি যেখান থেকেই এবং যে ভাবেই আসুক সীমান্ত বাংলার ঝুমুরের যা বৈশিষ্ট্য তা এই পুরুলিয়া তথা মানভূম অঞ্চলেরই নিজস্ব।’[8] মানভূম অঞ্চল বলতে বোঝানো হয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা ও ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার কিছু অংশ নিয়ে যে জেলা গঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ সময়ে, সেই অঞ্চলটিকে। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত’র  আবার মত—‘ঝুমুর ঝাড়খণ্ডের বিশিষ্ট প্রেম সংগীত। করম নাচ ও নাচনী নাচের গান ঝুমুর নামে পরিচিত। তবে সাধারণত দীর্ঘায়তনের প্রেম সংগীতগুলো যা নাচনী নাচে গীত হয় তেমনি একক ভাবেও গীত হয়, যা ঝুমুর নামে পরিচিত।’[9] এখানে ঝাড়খণ্ড জায়গাটির প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে বলা দরকার। ঝাড়খণ্ড কিন্তু ২০০০ সালের ১৫ নভেম্বরে গঠিত হওয়া ভারতীয় একটি অঙ্গরাজ্যের নাম মাত্র নয়, এই নামের ইতিহাস বহু প্রাচীন। এই বঙ্কিম মাহাতরই লেখা ‘ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য’ গবেষণাগ্রন্থটিতে লেখক বলেছেন যে: ‘বাংলা সাহিত্যে ঝাড়খণ্ডের প্রথম উল্লেখ সম্ভবত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’গ্রন্থেই করা হয়েছে। এই গ্রন্থের বহু উচ্চারিত পংক্তিগুলো হল- "ঝারিখণ্ড স্থাবর জঙ্গম আছে যত/ কৃষ্ণ নাম দিয়া কৈল প্রেমেতে উন্মত্ত।।/ মথুরা যাইবার কালে আসেন ঝারিখণ্ড।/ভিল্লপ্রায় লোক তাঁহা পরম পাষণ্ড।।"'[10]

বস্তুত, এই যে আলোচ্য অঞ্চলকে আমরা রাঢ়ভূমি বা মানভূম বলছি, যাকে কিনা সুকুমার সেন জঙ্গলমহল-ও আখ্যা দিয়েছিলেন, এই অঞ্চলটিকে ঝাড়খণ্ড নাম দেওয়ার জন্য বহু মানুষই চেষ্টা করে চলেছেন। শান্তি সিংহ রচিত ‘টুসু’ বইতে তিনি লিখছেন-“তাঁরা রাঢ়-বঙ্গের সুপ্রাচীন, ধারাবাহিক ঐতিহ্য বুঝি-বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্মৃত হয়ে, বাঙলার পশ্চিম দিকের ভৌগোলিক সীমা তথা ভাষা-সমাজ-কৌমাবিন্যাসের বৈজ্ঞানিক ভাবনায় উদাসীনতা দেখিয়ে, রাজনৈতিক চেতনার সংক্ষোভজাত রুদ্ধ অভিমানে কিছুটা বিচ্ছিন্নতাবাদী মন নিয়ে ‘ঝাড়খণ্ড’ অভিধায় এক বিশেষ ভৌগোলিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে চাইছেন।”[11]

এতক্ষণ আমরা মূলত অঞ্চলভেদে ঝুমুরের প্রকার ও তার সার্বিক বৈশিষ্ট্য ,  বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। এবার আসা যাক, ঝুমুর গানের গঠনগত প্রকৃতি নিয়ে, অর্থাৎ ঝুমুর কীভাবে লেখা হয়। ঝুমুর এক কথায় স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সঙ্গীত। বেশ কতকগুলি স্তবকের সমন্বয়ে এই গান লেখা হয়। স্তবকগুলির শেষে ধ্রুবপদ বা রং থাকে। তবে ঝুমুরে রং সংক্ষিপ্ত। বাংলা সাহিত্য-ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতে ঝুমুর গানের অঙ্গ মোট চারটি—সখী সংবাদ ও ব্রজলীলা, আগম বা ভবানী বিষয়ক, লহর বা শ্লেষ ব্যঙ্গ এবং খেউড় আদি রসাত্মক উক্তি প্রত্যুক্তি-সহ গীতাদি।[12]

বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে ঝুমুরের একাধিক প্রকারভেদ করেছেন লোকসংস্কৃতি গবেষকগণ। আশুতোষ ভট্টাচার্য যে ভাগটি করেছেন, সেখানে ভাগটি হয়েছে পদের বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে। সেগুলি হল— কৃষ্ণলীলা ঝুমুর,  রামলীলা ঝুমুর,  লৌকিক ঝুমুর,  সাঁওতালি ঝুমুর ও  টপ্পা ঝুমুর। বিষয়নির্ভর প্রকারভেদ করেছেন বিনয় মাহাতও। তাঁর ভাগগুলি হল,লৌকিক ঝুমুর,  রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক ঝুমুর,  পৌরাণিক ঝুমুর,  নাচনি শালিয়া ঝুমুর বা দরবারি ঝুমুর,  আদি রসাত্মক ঝুমুর বা টাইড় ঝুমুর। আবার, সুবোধ বসুরায়ের মতে ঝুমুর তিনপ্রকার—উচ্চাঙ্গ ঝুমুর,  লৌকিক ঝুমুর,  মেঝাইল ঝুমুর। সুধীর করণ-কর্তৃক শ্রেণিবিভাগটি আবার যেসব নাচে ঝুমুর গান গাওয়া হয়, সেই নাচের উপর ভিত্তি করে। সেগুলি হল—দাঁড় ঝুমুর,  টাইড় ঝুমুর,  কাঠি নাচের ঝুমুর ও  নাচনি নাচের ঝুমুর।[13]

এখানে আবার একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, এই যে নাচগুলির কথা বলা হল, অর্থাৎ যে নাচগুলি ঝুমুরের তালে প্রদর্শিত হয়, এইসব নাচ কিন্তু ঋতুভিত্তিক। যেমন, ভাদ্র মাসের শেষে  করম পরবে  (চিত্র ৪) যে ঝুমুর গাওয়া হয়, তাকে ভাদরিয়া ঝুমুর বলে।[14] আবার আশ্বিন মাসে অনুষ্ঠিত হয় ডাঁইড় নাচ। ডাঁইড় নাচ মানভূমের লোকসংস্কৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ।   এই নাচের ঝুমুরকে বলা হয় ডাঁইড় নাচের ঝুমুর। কার্তিক মাসে অহিরা গানের মাঝে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময় শিল্পীরা কাঠি নাচ করে থাকেন। এই কাঠি নাচের ঝুমুরে যে তাল ব্যবহৃত হয়, তার একটি স্বতন্ত্র রূপ আছে। এই তালটিকে বলে কাঠি তাল আর গীতটিকে বলে কাঠি নাচের ঝুমুর। একইভাবে অগ্রহায়ণ মাসের বুলবুলি নাচ, মাঘ মাসের নাচনি নাচ, ফাল্গুন মাসের বাঈ নাচে ঝুমুর পরিবেশন করা হয়। সুতরাং, নাচের ভিত্তিতে ঝুমুরের শ্রেণিবিন্যাস কিন্তু অনেকাংশেই ঋতুভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস কারণ, প্রত্যেকটি নাচের সময়কাল, প্রেক্ষিত, আঙ্গিক ভিন্ন।

চিত্র ৪. করম পরব পালন। (সৌজন্যে: WBXpress)
চিত্র ৪. করম পরব পালন। (সৌজন্যে: WBXpress)

ঝুমুর: পঞ্চঋতুর গান
গ্রীষ্মের দাবদাহের সময়টি বাদ দিলে বছরের প্রায় সাত মাসই ঝুমুরের তানে মাতোয়ারা থাকেন মানভূমের মানুষ। কখনও বিশুদ্ধ ঝুমুর পদ, কখনও আবার ঝুমুরের সুর-মিশ্রিত গানে গলা মেলান স্থানীয়রা। স্থানীয় যেসব মানুষ ঝুমুর লেখেন ও সুর দেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কৃষিজীবী, কেউ কেউ আবার অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, যেমন ছোটখাটো ব্যাবসা বা কবিরাজি চিকিৎসা। (চিত্র ৫) শ্রাবণ মাসে ধান লাগানোর সময়ে, ক্ষেতের আলের উপর বসে পুরুলিয়ার মানুষ মনকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতে যে গান করে থাকেন, তাকে ‘ধান লাগানোর গান’ বা কবি গান বলা হয়।[15] এই গান কিছুটা ঝুমুরের সুরে গাওয়া হয়। মূলত দু’রকম ছন্দে এই গান রচিত হয়—ত্রিপদী ও পয়ার।

চিত্র ৫. বলরামপুরের ‘রয়্যাল ছৌ অ্যাকাডেমি’তে রুচাপ গ্রামের স্থানীয় ঝুমুর শিল্পী গুরুচরণ মাহাত। তাঁর হাতে তাঁরই লেখা একটি ঝুমুর গানের সংকলন ‘আধুনিক যুগের বর পনের চাবিকাঠি’। গুরুচরণ মাহাত পেশায় কৃষিজীবী। তাঁর ঘোড়ানৃত্যের দল রয়েছে। দলের সম্মুখভাগে দুটি ঘোড়ার উপর নাচিয়েরা নাচেন বলে এই নাচকে ঘোড়ানৃত্য বলে। ঝুমুরের তালেই হয় এই নাচ। ঝুমুর ছাড়াও অহিরা ও টুসু গানও লিখে থাকেন গুরুচরণ। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৫. বলরামপুরের ‘রয়্যাল ছৌ অ্যাকাডেমি’তে রুচাপ গ্রামের স্থানীয় ঝুমুর শিল্পী গুরুচরণ মাহাত। তাঁর হাতে তাঁরই লেখা একটি ঝুমুর গানের সংকলন ‘আধুনিক যুগের বর পনের চাবিকাঠি’। গুরুচরণ মাহাত পেশায় কৃষিজীবী। তাঁর ঘোড়ানৃত্যের দল রয়েছে। দলের সম্মুখভাগে দুটি ঘোড়ার উপর নাচিয়েরা নাচেন বলে এই নাচকে ঘোড়ানৃত্য বলে। ঝুমুরের তালেই হয় এই নাচ। ঝুমুর ছাড়াও অহিরা ও টুসু গানও লিখে থাকেন গুরুচরণ। (সৌজন্যে: সোহম দাস)

(ত্রিপদী ছন্দ)

কচড়া তরকারির জন্যে মন ধরা ধরি-

তরকারির বাঁটলো মাই তোরি-

ছোট বাবুই ভাত খাই নাই বড়কি খনঞ্জরি।।[16]

(অর্থ – ‘কচড়া’ অর্থে মহুয়া গাছের ফল। সেই ফলের তরকারির জন্য (কারও) মন আনচান করছে। সেই তরকারি রান্নার জন্য সবজি আনাজ কেটে কুটে রাখছেন ‘মাই তোরি’ অর্থাৎ মেজো বউ। বাড়ির ছোট বাবু স্বভাব বড় মুখরা এদিকে তাঁর এখনও ভাত  খাওয়া হয়নি।)

(পয়ার ছন্দ)

বঁধুর কাছে দুখের কথা কত কাঁন্দিয়া কাঁন্দিয়া,

লোদির বানে ঝাঁপ দিব বুকে পাষান বাঁধিয়া।।[17]

(অর্থ – বঁধু অর্থাৎ গৃহবধূ। তাঁর কাছে পরিবারের জনৈক সদস্য নিজের দুঃখের কথা বলে বিলাপ করছেন। মনের দুঃখে তিনি ‘লোদি’ অর্থাৎ নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের কথাও ভাবছেন।)

শ্রাবণ মাসের পরে আসে ভাদ্র মাস। এই  মাসের ঝুমুরকে বলা হয় ভাদরিয়া ঝুমুর। এই ঝুমুরের কথায় ও সুরে ভাদ্রমাসের প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষের অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীভক্তু মাহাত’র মতে-“ভাদরিয়া সুরের এমনই ছন্দ যে, যে কোন সময়ে পরিবেশন যদি কেহ করে থাকেন, গানের সুরেই বলে দেয় ইহা ভাদরিয়া ঝুমুর। যেমন-শাস্ত্রিয় সঙ্গিত স্বরের চলন হিসাবে বলে দেয় কোন ঠাটের রাগ বা কোন রাগ পরিবেশন হচ্ছে।”[18] ভাদরিয়া ঝুমুর বাদ্যযন্ত্র ছাড়া বা তাল ছাড়াও গাওয়া হয়। এই ঝুমুরের পদ মূলত পয়ার ছন্দেই লেখা হয়।

১। ভাদর মাসের গাদর জনাইর, জল হৈল ঘাট হে,

পুড়ে গেল, আমার ভাদর মাইসা লেট হে, পুড়ে গেল।।

২। ভাদর মাসের গাদর জনাইর, আইড়ে বসে খাব হে,

যারেই দেখিব মমের ছাতা, তারেই সঙ্গে যাব হে।।[19]

(অর্থ – ‘ভাদর মাস’ অর্থে ভাদ্র মাস এবং ‘গাদর জনাইর’ অর্থে আধপাকা ভূট্টাদানা। বর্ষা ঠিকমতো না হওয়ায় সেই ভূট্টা ক্ষেত পুড়ে গেল। কাজ করতে করতে ক্লান্ত কৃষক সেই ভূট্টাদানা খায় ‘আইড়’ অর্থাৎ ক্ষেতের আলে বসে। প্রচণ্ড গরম হওয়ায় যার হাতে ‘মমের ছাতা’ অর্থাৎ মোম-লেপিত কাপড় দেখবে, তার সঙ্গেই সে বাড়ি ফিরবে।)

আশ্বিন মাসে যে ঝুমুর গাওয়া হয়, সেই ঝুমুরের তালে অনুষ্ঠিত হয় ডাঁইড় নাচ। সাতজনের অধিক সংখ্যক ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে হাতে হাত ধরে নাচ পরিবেশন করে। বাদ্যযন্ত্র হিসাবে এখানে ব্যবহৃত হয় ঢোল, নাগাড়া, মাদল ও টিটকারি বাঁশি বা সানাই। অন্তত দুজন ঝুমুরিয়ার প্রয়োজন পড়ে। ১৯৫০ সালের আগে এই নাচ প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই অনুষ্ঠিত হতো এবং সেখানে ছেলে-মেয়ে-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই জাতি-সম্পর্ক নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু ১৯৫০ সালের পর থেকে এই নাচ কমতে কমতে বর্তমানে প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। ভাদ্রমাসের করম একাদশীর রাত থেকে এই নাচ শুরু হয় এবং তা চলে পুরো আশ্বিন মাস জুড়েই। কার্তিক মাসের কালীপুজোর পর বুড়ি বান্দনার বা কাঁটাকাড়ার দিনের রাত্রে শেষে টুসুর গান আরম্ভ হওয়া দিয়ে এই নাচ সমাপ্ত হয়। মূলত ভাদরিয়া তাল ও পয়ার ছন্দেই এই ডাঁইড় নাচের ঝুমুর গাওয়া হয়।

১। আকড়া বন্দনা করি, গনেশ শংকর গৌরী,

গুরুর চরণে নমস্তুতি, দয়া করো দেবী স্বরসতি।।

২। আকড়া বন্দনা করি,গুরুর চরণ ধরি,

আকড়া বন্দনা বেজনারী, মদনে ঝুমোইর লাগে ভারি।।[20]

(অর্থ – ‘আকড়া’ অর্থাৎ আখড়া বা দেবস্থান, সেখানে গনেশ, মহাদেব ও দেবী দুর্গা ও সরস্বতীর বন্দনা হয়। এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ‘ঝুমোইর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বেজনারী মদন’ অর্থাৎ ব্রজনারী বা শ্রীকৃষ্ণ, যিনি কিনা কামেরও দেবতা, তাঁর কথা বলা হয়েছে। মধ্যযুগীয় ঝুমুরের এটি একটি উতকৃষ্ট উদাহরণ।)

ভাদরিয়া ছাড়া আরেক ধরনের তালে এই ঝুমুর গাওয়া হয়, সেটি হল খেনতা তাল। সেই ঝুমুরের ছন্দটি হল ত্রিপদী। এই খেনতা তাল সকল বায়েন বাজাতে পারেন না। তাই আসরে খেনতা তাল গাইতে হলে আগে বায়েনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হয়।

১। ঘুঘি আড়া বিমুখ জ্বালা রাইত ঘুমায় কোন সালা হে

মরি হায় হায়,

ঘরের লোকে বলে যাওনা ঘুঘি জান,

নাই যাব গো আমরা বড়ই অপমান।।[21]

(অর্থ – রাতে ক্ষেতের আলে মাছ উঠেছে, এমন সময়ে যে ঘুমিয়ে থাকে, সে আসলে বোকা। ‘ঘুঘি’ হল আলে মাছ ধরার যন্ত্র। ঘরের লোক তাকে আলে যেতে বললেও সে নিজের মানমর্যাদার কথা তুলে সেই কাজ থেকে বিরত থাকে।)

২। কাড়া বাগাল রাইত কানা রাইতে কাড়, খুলতে মানা হে

মরি হায় হায়,

খুখড়া ডাকে না খুইলে কাড়া মাতায় নাই,

কাড়া লড়াই হে ইবছর হবেক কি নাই।।[22]

(অর্থ – ‘কাড়া’ অর্থে মহিষ। কাড়ার যে বাগাল, অর্থাৎ রাখাল, সে রাতকানা হওয়ায় রাতে মহিষকে বেঁধে রাখে। কিন্তু ভোর হলেই মহিষকে ভাল ফসল খাওয়াতে হয়, তাতে সে এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সেই ঘোর-লাগা ভাব মহিষ-লড়াইয়ে খুবই উপযুক্ত। কিন্তু এবছর তা হবে কিনা, সেই নিশ্চয়তা নেই, এদিকেসেই লড়াই না হলে মানুষের বিনোদন বলে কিছু থাকে না।)

কার্তিক মাসে যে অহিরা গাওয়া হয়, সেই গান শুরু হয় কালীপুজোর রাত্রে, অর্থাৎ কার্তিক মাসের প্রথম অমাবস্যার রাত্রে। যতক্ষণ না অন্য অহিরা গাওয়া হয়, ততক্ষণ এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময় কাঠি তালে ও ত্রিপদী ছন্দে ঝুমুর গাওয়া হয়।

উপরে সুরুযের ছটা নামোয় তাতা বালি রে

নামোয় তাতা বালি।

ও প্রাণের নিমাইরে চলিতে না পারে সীতা

করিছে বিকলিরে করিছে বিকলি।।[23]

(অর্থ – সূর্যের তীব্র আলোকচ্ছটায় বালি তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাই সেই বালিতে হাঁটা বড়ই কষ্টকর।)

কার্তিকের পরের মাস অগ্রহায়ণে আবার সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের নাচ হয়। এই নাচে ৭ থেকে ১৩ বছরের কিশোররা মেয়ে সেজে অংশগ্রহণ করে। বেশি লম্বা বা ১৩ বছরের বেশি কিশোরদের এই নাচে নেওয়া হয় না। এই নাচটি হল বুলবুলি নাচ। এই নাচের ঝুমুর গায়ককে বলা হয় রসিক বা মাদোইলা। কারণ, ঝুমুরের গানটি গাওয়া হয় মাদল বাজিয়ে। ডাঁইড় নাচের সঙ্গে বুলবুলি নাচের পার্থক্য হল ডাঁইড় নাচে যত বেশি সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করবেন, তত সেই নাচ জমে ওঠে কিন্তু বুলবুলি নাচে কখনোই বেশি নাচিয়ে চলবে না। এছাড়াও, ডাঁইড় নাচে যে হাত ধরাধরি করে নাচা হয়, সেই রেওয়াজ বুলবুলিতে নেই। বুলবুলি নাচে সাধারণত পয়ার ছন্দে পাঁচমিশালি ঝুমুর পরিবেশন করা হয়।

মুখ ধুবে সকালে, বাইসাম খাবে বিকালে,

কম কম খাবে বন্ধু ই বছরের আকালে।।[24]

(অর্থ – ‘বাইসাম’ অর্থাৎ সকাল কেটে যাওয়ার পর একটু বেলার দিকে বা দুপুরে-বিকালে যে খাবার খাওয়া হয়। এখানে সকালে মুখ ধোয়ার পর প্রায় সারাদিন উপবাসে কাটিয়ে বিকালে খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ হিসাবে, পরবর্তী লাইনেই বলা হচ্ছে, আকাল অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের কারণে সকলকেই খুব অল্প খেয়ে  রোজকারে আহার সমাধা করতে হবে।)

পৌষ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তির দিন টুসু ধ্বনির বিসর্জনে ঝুমুর গান গাওয়া হয় (চিত্র ৬)। এই গানের ভাষা মূলত হয় খেউড়-বহুল। গৃহবধূরা তাঁদের বাড়ির পুরুষদের উদ্দেশ্যে খিস্তি-খেউড় বিসর্জন করেন। পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ মাঘ মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় নাচনি নাচ প্রদর্শন (চিত্র ৭)। এই দিনটিকে বলা হয় আখাইন যাত্রার দিন। এদিন যাত্রাবুড়ির দেবস্থানে নাচনি নাচ পরিবেশিত হয়। গ্রামে গ্রামে উদযাপিত হয় ভানসিংহ মেলা (চিত্র ৮)। ত্রিপদী ছন্দে নাচনি নাচের একটি গৌরাঙ্গ বন্দনার উদাহরণ এখানে দেওয়া হল—

হরি হে...

গৌউরাঙ্গ পদ কমল, কোটি চন্দ্র সুশীতল,

ছায়া রূপে জগৎ জুড়ায়।

হরি নাম বিলাইতে, পাপি তাপি উদ্ধারিতে,

আসিয়াছে এভব ধারায়।।

হো গৌউর বিনে ভাই, রাধা-কৃষ্ণ পেতে চাই

ভজ রাঙ্গা চরণ তাহার।

সেই সব সম্বন্ধ নাই যার, বৃথায় জন্ম গেল তার,

সেই পশু দুরাচার।।[25]

(অর্থ – এখানে গৌরাঙ্গ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্যের  পায়ে যেন ফুটে রয়েছে পদ্ম, তাঁর শরীর চাঁদের মতো শীতল, তাঁর অপরূপ দেহলাবণ্যে জগতের মানুষ যেন বিভোর। কৃষ্ণের নাম প্রচার করে তিনি  মানুষকে এ জগত সংসারের সমস্ত পাপের বোঝা থেকে উদ্ধার করতে চান। গৌরাঙ্গকে অস্বীকার করে বুঝি রাধা-কৃষ্ণের সান্নিধ্য পাওয়া অসম্ভব। তাই গৌরাঙ্গের এমন মহিমাকে যে বুঝতে পারেনি, তার জন্মই বৃথা।)

চিত্র ৬. টুসু বিসর্জন। ছবি সৌজন্যে: শুভদীপ চক্রবর্তী। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৬. টুসু বিসর্জন। (সৌজন্যে: শুভদীপ চক্রবর্তী)
চিত্র ৭. ডুবকিডি গ্রামের ভানসিংহ মেলায় নাচনি নাচ প্রদর্শন। শিল্পীর নাম পস্তুবালা দেবী কর্মকার। আগে এই নাচে মাইক ব্যবহৃত হত না, কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাইকের প্রচলন হয়েছে। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৭. ডুবকিডি গ্রামের ভানসিংহ মেলায় নাচনি নাচ প্রদর্শন। শিল্পীর নাম পস্তুবালা দেবী কর্মকার। আগে এই নাচে মাইক ব্যবহৃত হত না, কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাইকের প্রচলন হয়েছে। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৮. ডুবকিডির ভানসিংহ মেলা। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৮. ডুবকিডির ভানসিংহ মেলা। (সৌজন্যে: সোহম দাস)

ফাল্গুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় বাঈ নাচ। নাচিয়ে মেয়েরা রাজপোষাকে এই নাচ নেচে থাকে। আগে সরস্বতী পুজো থেকে আরম্ভ হয়ে শিব পুজোর আগে অবধি হতো, এখন প্রায় সারাবছরই অনুষ্ঠিত হয় এই নাচ। ত্রিপদী ও পয়ারের দুটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হল—

(নারায়ণ বন্দনা—ত্রিপদী ছন্দ)

মৎস্য অবতারে বেদের উদ্ধার, কুর্ম্ম অবতারে স্থাপিলে সংসার

ওহে প্রভু পৃষ্ঠে করি হে।

বরাহ রূপ ধরে, এই পৃথিবীতে, উদ্ধারিলে দন্তে করি হে।। রং

রং:- নমঃ নারায়ণ পুরুষ রতন, শংখ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারি হে।।

হইলে পরশুরাম ভৃগুপতি, নিক্ষত্রিয়া তিনসপ্ত বসুমতি,

ক্ষত্রিয় দিগকে মারি হে।

বামন বেশেতে, ছলিয়া বলিতে, হইলে তাহার দ্বারি হে।। রং

নরসিংহ রূপ স্তম্ভের ভিতর, ভক্ত প্রহ্লাদেরি প্রভুরক্ষা কর,

হিরন্য কশিপু মারি হে।

রাম অবতারে মেরে রাবণেরে, রক্ষা কৈল্যে দেবতারি হে।। রং

কৃষ্ণরূপে জন্ম নিলে দ্বারকাতে, কংস ধ্বংস কৈল্যে মথুরাপরেতে,

ওহে প্রভু বংশি ধারি হে।

অর্জ্জুন ভন্যে ঐ রাঙ্গাচরণে, দয়া করো ভিক্ষা করি হে।। রং[26]

(অর্থ – এই গানে নারায়ণ অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মহিমাকীর্তন করা হয়েছে। মৎস্য অবতারে তিনি মনুসংহিতা, যিনি  বৈদিক পৃথিবীকে রসাতলে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।  কুর্ম্ম অবতারে অবতীর্ণ হয়ে তিনি পৃথিবীতে স্থিতাবস্থা এনেছেন, বরাহের রূপে এসে রাক্ষস হিরণ্যাক্ষকে হত্যা করে তাঁর সুদীর্ঘ দন্তের মাধ্যমে পৃথিবীর দেবীকে সমুদ্রর তলদেশ থেকে উদ্ধার করেছেন।  শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম যাঁর হাতে, সেই ভগবান বিষ্ণুই কখনও হয়ে উঠেছেন সর্বক্ষত্রিয়-নাশী পরশুরাম, আবার তিনিই বামনের রূপ ধরে কৌশলে পাতালে ফেরত পাঠিয়েছেন তাঁরই অতিবড় ভক্ত মহাবলিকে, কখনও স্তম্ভের মধ্যে থেকে নরসিংহের অবতারে বেরিয়ে এসে হিরণ্য কশিপুকে হত্যা করে রক্ষা করেছেন ভক্ত প্রহ্লাদকে, আবার কখনও বা হয়েছেন রাবণ-বিনাশী রামচন্দ্র, এবং কখনও বা কংস-বিনাশী শ্রীকৃষ্ণ, যাঁর হাতে শোভা পায় মনমোহিনী বাঁশি, যাঁর পদতলে আশ্রয় নেন বীরযোদ্ধা অর্জুন।)

(প্রথম দর্শন—পয়ার ছন্দ)

পথের মাঝে দেখা হৈল্য, রূপ দেখে মন ভুলে গেল হে।

কিবা নামের হও গো তুমি, কোথায় ঠিকানা, কথা খুলে বল না।। রং

রং:- প্রেম বানে জ্বরজ্বর ব্যথা দিতেছে মদনা।।

জাতি বিচার না করিল, নয়নে আপন করিল হে।

বিবেককে মন না বুঝিল জ্ঞানান্তে কানা, বয়সের দোষ দিও না।। রং

যদি হয় গো গরীব ছেলে, মাটিতে শুয়ে স্বপ্ন দেখিলে হে।

ধনির দুলাল টাকার জোরে পুরায় বাসনা, একি বিধাতার ছলনা।। রং

প্রেম বাগানের মধুর গন্ধে, মিলিতে মন চাই আনন্দে হে।

ভক্তু বলে এক ব্রহ্ম, দুইয়ে পড়ো না, দেইখ নাস্তিক হইও না।। রং[27]

(অর্থ – কোনও এক দরিদ্র যুবক এক অপরূপা নারীর প্রেমে সিক্ত। কিন্তু হয়ত সেই কন্যা উচ্চজাতের, উচ্চবংশের, উচ্চবিত্তের। ফলে গরীবের পক্ষে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে সেই প্রেমের পূর্ণতার স্বপ্ন দেখা কেবল অলীকই থেকে যায়।)

চৈত্র মাসে শিব পুজোর জাগরণের রাত্রিতে উচ্চ পর্যায়ের শরীরচর্চা ও ব্যায়ামের সঙ্গে ঝুমুর গান পরিবেশিত হয়। একটি উদাহরণ-এর মাধ্যমেই তা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়—

রং:- নমামি শংকরী, তব নামে তরী ও ছল

বুঝিতে না পারি তোমারি মা-

ও লীলা বুঝিতে না পারি তোমার মা - - ।।[28]

(অর্থ – শংকরী অর্থাৎ দুর্গার নামেই রয়েছে ছলনা। তাঁর লীলা বুঝতে পারা সত্যিই কঠিন।)

আদি, মধ্য ও আধুনিক যুগের ঝুমুর: সমৃদ্ধতর সাহিত্য থেকে অবক্ষয়ের পথে
ঝুমুরের প্রকৃত বয়স কত, অর্থাৎ কতদিন আগে ঝুমুর প্রথম লেখা হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। ঝুমুরের উল্লেখ যে প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে পাওয়া যায়, যেমন পূর্ব উল্লিখিত সঙ্গীত দামোদর, বিদ্যাপতির পদ (চৈতন্য-পূর্ববর্তী), গোবিন্দদাসের পদ (চৈতন্য-পরবর্তী), এছাড়া আইন-ই-আকবরী, সেদিক থেকে এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট যে, ঝুমুর এক অতি প্রাচীন শিল্প।[29] ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার প্রখ্যাত ঝুমুর গবেষক তথা আইনজীবী গিরীশ মহন্ত তাঁর Jhumur and Jhumur Desh শীর্ষক ইংরাজি গবেষণাপত্রে ঝুমুর সাহিত্যকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন—আদিযুগ (১৭৫০ খিস্টাব্দের পূর্ববর্তী সময়), মধ্যযুগ (১৭৫০–১৮৫০), কাব্যযুগ বা স্বর্ণযুগ (১৮৫০–১৯৫০) এবং আধুনিক যুগ বা সবুজ যুগ (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ-পরবর্তী)।[30] তবে মধ্যযুগে আমাদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যে ঘটনা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল, অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব, ঝুমুরের ক্ষেত্রেও তার কোনও অন্যথা হয়নি। শ্রীচৈতন্যের পূর্ববর্তী সময়ে যে ভণিতাহীন ঝুমুরের প্রচলন ছিল, পরবর্তীকালে সেই ঝুমুরই অনেক ভণিতাযুক্ত হয়। এর কারণ হিসাবে গবেষকরা  বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবকেই  চিহ্নিত করেছেন। চৈতন্যচরিতামৃতের যে শ্লোকটি (ঝারিখণ্ড-বিষয়ক) পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানেই চৈতন্য পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের সমার সমষ্টিগত ভাবনা এবং জনমানসের  পরিবর্তনের আভাস রয়েছে।  ঝুমুর সাহিত্যকে আমরা ভাগ করতে পারি এইভাবে-আদিযুগ (চৈতন্য-পূর্ববর্তী সময়ের ঝুমুর), মধ্যযুগ (চৈতন্য-পরবর্তী সময় থেকে ব্রিটিশ-শাসন মুক্ত হওয়ার সময়কালে রচিত ঝুমুর) এবং আধুনিক যুগ (স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ঝুমুর)।[31]

আদিযুগের ঝুমুরের নিদর্শন বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। তাও যেটুকু এখনও সংরক্ষিত আছে, সেগুলি পড়লে বোঝা যায়, সেখানে মানভূমের মানুষের দৈনন্দিন জীবনেরই চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। মাছ ধরা, সবজির চাষ, ফুল তোলা বা ফল পাড়ার মতো অতি পরিচিত গ্রামীণ দৃশ্য সেখানে উপস্থিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আদিযুগের ঝুমুরের পদে পদকর্তাদের নাম থাকত না। ফলে এই পদগুলি কাদের লেখা সে বিষয়ে আর কোনও তথ্য জানা সম্ভবপর নয়। এই অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, হো, খাড়িয়া, বীরহড়দের মধ্যে যে নিজস্ব সংস্কৃতি বর্তমান সেগুলো তখনও পালিত হতো। ভাদ্র মাসে করম ও ভাদু পরব, তারপরের বাঁধনা পরব, টুসু পরব উপলক্ষ্যে যেসব গান ও নাচ অনুষ্ঠিত হতো, তা আজও একইভাবে অনুষ্ঠিত হয়। বরং প্রাচীন সেই সময়ের আরও নানা আচার-নিয়ম আজ কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে। যেমন ভাদরিয়া ঝুমুরের বহু সুর তালই এখন আর নেই। ডহরওয়া, পতরতুলা, বেঁগাড়ি, পাটিয়ামেধা, রিঁঝামাঠা, ঝুমরা, ঝুমটা, মুদিআরি এরকম বেশ কিছু সুর ও তাল এখন কেবল অবশিষ্ট আছে। আদিযুগের ঝুমুরের আরেকটি বিশেষত্ব হল, এই সময়ে গ্রামের কুমারী মেয়ে থেকে শুরু করে বিবাহিতা বধু সকলেই বিভিন্ন নৃত্যানুষ্ঠান বা পালায় অংশগ্রহণ করত। তাদের কোনও বাধানিষেধ ছিল না। এছাড়া, এই অঞ্চলের নানা কৃষিজীবী ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী সম্প্রদায় যেমন কুড়মি, কুমহার, রাজোয়াড়, মাল মহালি, হাড়ি, ভূমিজ, বাগদি এদের যেসব গোষ্ঠীনৃত্য ও কৌমনৃত্য হতো, সেখানে মেয়ে বউ সকলেই একসঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করত। পুরুষদের ভূমিকা ছিল আনুষঙ্গিক যন্ত্র-বাদকের।[32]

মধ্যযুগের ঝুমুরে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব। এর সঙ্গে ঝুমুরে এসে মিশেছে হিন্দু, শাক্ত, সহজিয়া, বৌদ্ধ, জৈন, নির্গুণ তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জন্মান্তরবাদ, রামায়ণ, মহাভারত, পৌরাণিক কাহিনী। সামাজিক রক্ষণশীলতাও এই সময়ে অনেক বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। মহিলারা আর আগে মতো জনসমক্ষে উপস্থিত হতে পারছেন না। আদিবাসী, কৃষিজীবী ও বৃত্তিজীবী সম্প্রদায়ে যে কৌমভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল, তা ভেঙে পড়ছে। আদিযুগে গ্রামে গ্রামে যে আখড়া হতো, যেখানে সঙ্গীতচর্চা, নাট্যচর্চা চলত, সেখানে জায়গা নিচ্ছে হরিমন্দির। বৈষ্ণব প্রভাবে তৈরি হচ্ছে যাত্রা সংকীর্তনের দল। তবে এই যুগে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, রাজদরবারে ঝুমুরের বিশেষ গুরুত্ব লাভ। বেগুনকোদর, হেঁসলা, পঞ্চকোট, পাতকুম, বাঘমুণ্ডি, রাজওয়াগড়, কাশীপুর, সেরাইকেলা, বারিপদা ইত্যাদি জায়গার স্থানীয় রাজা ও জমিদারগণ ঝুমুরের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। এই সময়ে যেসব কবিগণ ঝুমুর চর্চা করেছেন যেমন বরজুরাম দাস, ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, জগৎ কবিরাজ, দুর্যোধন দাস, দীনা তাঁতি, বিনন্দিয়া সিং, উমাপদ পাণ্ডা, শিরোমণি পাণ্ডা, বাউল দাস, নরোত্তম দাস এঁরা সকলেই রাজ-অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। কোনও কোনও কবি তো নিজেরাও জমিদার বংশজাত ছিলেন। লখনৌ ও এলাহাবাদে নবাবের দরবারে যেমন বাঈজি নাচ হতো, একই প্রথার অনুকরণে এই সময় থেকেই জমিদারদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে নাচনি প্রথার আরম্ভ হয়। বরজুরাম দাসই এই শিল্পের উদ্ভাবন ঘটিয়েছিলেন বলে জানা যায়। নাচনি শিল্পী সিন্ধুবালা ও তাঁর রসিক (নাচনির সঙ্গী, যিনি গান করেন) চেপা মাহাত পঞ্চকোট  কাশীপুরের রাজাদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। তবে রক্ষণশীলতার বাধা থাকায় নাচনি হতেন তথাকথিত ‘পতিতা’ অথবা জমিদারের রক্ষিতা মেয়েরাই। এই মধ্যযুগেই ঝুমুর সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট পদগুলি রচিত হয়েছিল।[33]

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়টিকে ধরা হচ্ছে ঝুমুরের আধুনিক যুগ হিসাবে। এই সময়ে  দেশীয় রাজা ও জমিদাররা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ায়  এককালের জনপ্রিয় ঝুমুরশিল্পীরা পৃষ্ঠপোষকতা হারান। ফলে লৌকিক বা দরবারি ঝুমুর হিসাবে যা পরিচিত হয়েছিল মধ্যযুগে সেই নামটি কিন্তু সার্থকতা হারায়। ঝুমুরের পদে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী বা সহজিয়া দেহতত্ত্বের মতো গম্ভীর বিষয় সরে গিয়ে চলে আসছে বাস্তবজীবনের গান। সেখানে যমুনার মতো রাজকীয় নদী সরে গিয়ে স্থান করে নিচ্ছে কাঁসাই, শিলাইয়ের মতো স্থানীয় বৃষ্টিপুষ্ট নদীদের কথা। বর্তমানে সমাজ সচেতনতা, স্বাস্থ্য সচেতনতার মতো বিষয়ও স্থান করে নিচ্ছে ঝুমুরের কথায়। (চিত্র ৯) তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের মতো ঝুমুরের গতিপথও নিম্নগামী। মধ্যযুগের শেষ দিক থেকেই মধ্যমেধার কবিদের হাতে পড়ে ঝুমুরের কাব্যগুণ হ্রাস পেতে শুরু করেছিল।[34]  বর্তমানে সেই অবস্থা আরও সঙ্গিন। তবু তার মধ্যেও অনেক কবি ও শিল্পীই ঝুমুরকে বাঁচিয়ে জীবনভর লড়ে যাচ্ছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, তার উপর তাঁদের অনেককেই  বার্ধক্যে পেয়েছে। সলাবত মাহাত, বিজয় মাহাত, সুনীল বরণ মাহাতর মতো শিল্পীরা তো কিছুদিন হল মারাও গিয়েছেন। বর্তমানের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে সঠিক শিক্ষার আগ্রহও কম। ঝুমুরের মতো লোকসঙ্গীতের পক্ষে আরও উদ্বেগজনক বিষয়টি হল, যন্ত্রসভ্যতার বাড়বাড়ন্তে বিশুদ্ধ সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়ে সেখানে স্থান করে নিচ্ছে মিশ্র সংস্কৃতি। চটজলদি খ্যাতির মোহ অন্ধ করে দিচ্ছে বহু শিল্পীকেই। ঝুমুরের জগতে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট এক শূন্যতা। এই নিয়ে বেশ চিন্তিত সুনীল মাহাতর মতো নিষ্ঠাবান ঝুমুর গবেষক ও কবিগণ। নাচনি শিল্পের অবস্থা তো আরও খারাপ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সমাজে তাঁদের কেবল মনোরঞ্জনকারিনী হিসাবেই দেখা হয়ে এসেছে। বর্তমানে বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নাচনি থাকলেও তাঁদের পর এই শিল্পের একমাত্র পরিণাম মৃত্যু। তবে আশার কথা, সৈকত রক্ষিত, সুভাষ রায়, রবীনকুমার পাণ্ডে প্রমুখ উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা উৎকৃষ্ট ঝুমুর রচনায় মনোনিবেশ করছেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ এই শূন্যতাকে কতটা ভরাট করতে পারে, তা সময়ই বলবে। সর্বকালে, সর্বক্ষেত্রে শেষ কথা তো সে-ই বলেছে।

চিত্র ১০. ভিখারিচেলিয়ামা গ্রামের ঝুমুর শিল্পী বিশ্বম্ভর পরামানিক (মাঝের জন)। সত্তরোর্ধ্ব এই মানুষটি ছোট্ট একটি ঘরে থাকেন। তাঁর পেশা বলতে কবিরাজি চিকিৎসা। ঘরের মধ্যেই একপাশে ঝুমুরের বাদ্যসরঞ্জাম, অন্যপাশের তাকে রাখা থাকে কবিরাজি ওষুধ। ইনি মূলত স্বাস্থ্য-সচেতনতা ও পরিবেশ-সচেতনতা মূলক গানই লেখেন। (সৌজন্যে: সোহম দাস)
চিত্র ৯. ভিখারিচেলিয়ামা গ্রামের ঝুমুর শিল্পী বিশ্বম্ভর পরামানিক (মাঝের জন)। সত্তরোর্ধ্ব এই মানুষটি ছোট্ট একটি ঘরে থাকেন। তাঁর পেশা বলতে কবিরাজি চিকিৎসা। ঘরের মধ্যেই একপাশে ঝুমুরের বাদ্যসরঞ্জাম, অন্যপাশের তাকে রাখা থাকে কবিরাজি ওষুধ। ইনি মূলত স্বাস্থ্য-সচেতনতা ও পরিবেশ-সচেতনতা মূলক গানই লেখেন। (সৌজন্যে: সোহম দাস)

 

Notes

 

তথ্য সূচি ঃ

[1] সিংহ। “বঙ্গ-রাঢ়ের ইতিবৃত্ত: প্রান্তিক বাংলার সাংস্কৃতিক সীমানা।” টুসু, পৃঃ ১–১৪। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১৯৯৯।

[2] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা। “পুরুলিয়ার লোকসংগীত।” পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি, পৃঃ ১৭২–১৮৯। কলকাতা: অক্ষর প্রকাশনী, ১ম সংস্করণ, ২০১০।

[3] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[4] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[5] যৌথ সম্পাদনা। “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ।” ঝুমুর কথা, পৃঃ ৩–১২। কলকাতা: বাংলানাটক ডট কম, ২য় সংস্করণ, ২০১৬।

[6] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[7] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[8] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[9] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[10] সিংহ, শান্তি, “বঙ্গ-রাঢ়ের ইতিবৃত্ত”, পৃঃ ১–১৪।

[11] সিংহ, শান্তি, “বঙ্গ-রাঢ়ের ইতিবৃত্ত”, পৃঃ ১–১৪।

[12] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[13] ঘোষ বক্সি, ড. মিতা, “পুরুলিয়ার লোকসংগীত”, পৃঃ ১৭২–১৮৯।

[14] চক্রবর্তী, শুভদীপ। “বৃক্ষকে ঘিরে মানবিক চেতনার এক চিরন্তন উৎসব ‘করম পরব’।” প্রহর, ২০১৯।

[15] মাহাত, শ্রীভক্তু। "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।" শ্রীমতি সিন্ধুবালা দেবী ও বৃহস্পতি মাহাত কর্তৃক প্রকাশিত, ২০০১।

[16] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[17] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[18] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।'

[19] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[20] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[21] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[22] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[23] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[24] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[25] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[26] মাহাত, শ্রীভক্তু, পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[27] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[28] মাহাত, শ্রীভক্তু, "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত।"

[29] যৌথ সম্পাদনা, “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ”, পৃঃ ৩–১২।

[30] যৌথ সম্পাদনা, “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ”, পৃঃ ৩–১২।

[31] যৌথ সম্পাদনা, “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ”, পৃঃ ৩–১২।

[32] যৌথ সম্পাদনা, “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ”, পৃঃ ৩–১২।

[33] যৌথ সম্পাদনা, “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ”, পৃঃ ৩–১২।

[34] যৌথ সম্পাদনা, “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ”, পৃঃ ৩–১২।

 

গ্রন্থ তালিকা
সিংহ। “বঙ্গ-রাঢ়ের ইতিবৃত্ত: প্রান্তিক বাংলার সাংস্কৃতিক সীমানা।”  লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১৯৯৯।

ঘোষ বক্সি, ড. মিতা। “পুরুলিয়ার লোকসংগীত।”  কলকাতা: অক্ষর প্রকাশনী, ১ম সংস্করণ, ২০১০।

যৌথ সম্পাদনা। “ঝুমুরের আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ।”  কলকাতা: বাংলানাটক ডট কম, ২য় সংস্করণ, ২০১৬।

সিংহ, শান্তি, “বঙ্গ-রাঢ়ের ইতিবৃত্ত”।

চক্রবর্তী, শুভদীপ। “বৃক্ষকে ঘিরে মানবিক চেতনার এক চিরন্তন উৎসব ‘করম পরব’।” প্রহর, ২০১৯।

মাহাত, শ্রীভক্তু। "পুরুলিয়ার বার মাইসা সঙ্গীত"। শ্রীমতি সিন্ধুবালা দেবী ও বৃহস্পতি মাহাত কর্তৃক প্রকাশিত, ২০০১।