নীরবতার না-ভাষাতত্ত্বঃ লালনে

in Article
Published on: 17 June 2016

[ এটি এক বিদ্যে ব্যাবসায়ী তথা কথা-বনিকের জার্নাল,যাঁর বিশেষজ্ঞতার বিষয় ভাষাতত্ত্ব হলে কি হবে কার্যগতিকে ফিজিক্সের সঙ্গে ভাষাতত্ত্ব মিলিয়েজুলিয়ে কাজ কম্মো করেন।বিদ্যেব্যাবসার খাতিরেই ফান্ডেড/স্পনসরড অবস্থায় বাউলদের মধ্যে মাঠকম্মো থুড়ি ফিল্ড ওয়ার্ক করতে বেরিয়ে পরেন।তাঁর দিনলিপির কিছু নির্বাচিত অংশ,যা সিদ্ধচার্য লালনের দেহতত্ত্ব বিষয়ক তত্ত্বকথার সঙ্গে জড়িত,তা এখানে উপস্থিত করা হল।]

৩১/১/২০০৩

      অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটা জার্মান প্রজেক্ট পেয়ে গেলুম।টাকাটা আসছে জার্মানি থেকে;অবশ্য ব্যাপারটা বকলমে-কেননা আসলে এটা সামচাচার দেশের টাকা।ম্যানহাটনের বিদ্ধংসী বোমাপ্রকল্পের পর জিনোম প্রজেক্ট যত টাকা পয়সা ঢালা হয়েছে,তারও থেকে নাকি বেশী টাকা হবে এই প্রকল্পে।কী এমন প্রকল্প?প্রাথমিক ভাবে বোধগম্য হয়নি ব্যাপারটা।তবে যা বুঝলাম,সাধুসন্নেসিদের মস্তিষ্কের ওপর লাগিয়ে দেওয়া হবে নানান যন্ত্রপাতি।ঠান্ডা ঘরে তারা সে সময় ধ্যানস্থ থাকবেন।যন্ত্র-নজরে তাদের ধ্যানগম্ভীর অবস্থার উন্মোচন হবে মূলত দুটি স্ক্যান-প্রক্রিয়ার সাহায্যেঃ Position Emission Tomography (pet)ও Single Photon Emission  Tomography (SPECT)

   আজ ল্যাবে নিয়ে গেছিলেন প্রকল্প অধিকর্তা।কোথা থেকে এক সন্নেসিকে জুটিয়ে এনে তাঁর মাথায় কি সব বোতাম লাগিয়ে,কনুই-এর মধ্যে,পেটে-বুকে সর্পিল ক্যাথেটার ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে।নোনাজলে অনবরত হেপারিন দিয়ে ক্যাথেটার দিয়ে পরিস্কার করা হচ্ছে।Cerebral Angiography চলছে।

    প্রকল্প অধিকর্তা বললেন, “জানো-,SPECT-এ কয়েকজন সাধকের ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ধরা পড়েছে;এঁদের Frontal Lobe অতীব সক্রিয় এবং এতে intence neural activity থাকলেও Parital Lobe অতীব নিষ্ক্রিয়”।

   -তাতে আমি,মানে ভাষাতত্ত্বের লোক হিসেবে কী করবো?

   -এই Frontal Lobe-এ Broca’s area-মানুষের কথা বলার জায়গা।এবার যা বোঝার বুঝে নাও।তবে হ্যাঁ,কাজটা একটু তোমাকে সহজ করে দিই।নিউরোসায়েন্সের তরফ থেকে আমাদের যতটুকু সাহায্য করবার করবো,কিন্তু তোমাকে খুজে বের করতে হবে আউল-বাউলদের গানের ভিতর থেকে ‘ওদের’দেহতত্ত্ব বিষয়ক ‘পারসেপশনস’।আমি এবার অথৈ জলে।মজা মেরে গাঁজা টেনে দু’একবার আউল-বাউলদের গান শুনেছি বটে,তবে ৯০ শতাংশেরও বেশী গানের মানে বুঝিনি।ট্যান হয়ে গেছে।‘ওরা’ অন্য ভাষায় কথা কয়,যার বিষয়বস্তু আমার বোধগম্যতার বাইরে।যাই হোক,টাকাপয়হা প্যাঁদানো যাবে।ঘোরাঘুরি করতে হবে মানে Field Work-tourism আর কি!

     প্রকল্প-অধিকর্তা বললেন, “মনে রেখো ওরা সাঁটের ভাষায় উলটো কথা বলে।তোমার লিংগুইস্টিক্স-এর কারিকুরি দিয়ে ওদের ফন্দিফিকির বুঝতে হবে”।

     রাতে বাড়ি ফিরে মনে হল হটাৎ, “এত শরীর জানার,শরীরের তত্ত্বভাষা জানার অদম্য ইচ্ছে কেন এদের?কী করবেন এসব ‘অ-যৌক্তিক’পরিসর জেনে ওঁরা?কেন চাষাভুষোদের কথায় নজর দিচ্ছে ‘আধুনিক’বিজ্ঞান?”

০২/০২/২০০৩

     রাস্তায় বেরিয়ে এমন একখানা গান যে শুনে ফেলবো ফাঁকতালে,তা স্বপ্নেও ভাবিনি।

     লোকাল ট্রেনে এক বাউল গান গাইছেনঃ (লালন সাঁই-এর গান ১৪১)- “দেখ না রে ভাবনগরে ভাবের ঘরে ভাবের কীর্তী।।জলের ভিতরে রে জ্বলছে বাতি।।ভাবের মানুষ ভাবের খেলা ভাবে বসে দেখ নিরালা নীরে ক্ষীরে ভেলা বায় জুতি।।জ্যোতিতে রতির উদয় সামান্যে কি তাই জানা যায় তাতে কত রুপ দেখা যায় লালমোতিঃ।।যখন নিঃশব্দে শব্দেরে খাবে তখন ভাবের খেলা ভেঙ্গে যাবে লালন কয় দেখবি কি রে গতি”।।

     নিঃশব্দে শব্দেরে খাবে?কথাটার মানে কী রে বাবা!আঁতে ঘা লাগলো।যে আমি কিনা আমি পশ্চিমের ভাষাতত্ত্বে দীক্ষিত মানুষ এবং তারও পর ন্যাজামুড়ো ধারি,সেই আমি কিনা আমি এমন অদ্ভুত কথায় এসে ধাক্কা খেলুম?সম্বিত ফিরলো খানিকবাদেই।আরে এটাও তো একটা কাজের জায়গা হতে পারে!ভাবা যেতে পারে “নিঃশব্দের ভাষাতত্ত্ব”-এর কথা!তা নিয়ে পেপার লিখে ফেলা তো যায়।পেপার লিখতে গেলে পেপার বা কাগজ লাগে,কাগজ বানাতে গাছ কাটতে হয়;কালির জন্য সিসে ও কার্বন লাগে।এসব নিসর্গনাশক কাজ করতেই হয়-তবে কিনা তাতে পদোন্নতি হয়,পয়সা বাড়ে।অতএব,একে ছাড়া চলবে না।এর কথা শুনতে হবে।

     ততক্ষণে দেখি ঐ বাউল ভিখিরি আর এক গান ধরেছেন, (লালন সাঁই-এর গান ৫৯)- “লন্ঠনে রুপের বাতি জ্বলছে রে সদায়ঃ।।দেখ না রে দেখতে যার বাসনা হৃদয়ঃ।।রতির গিরে ফকসা মারা শুধুই কথার ব্যাবসা করাঃ তার কি হয় সে রুপ নেহারা মিছে গোল বাঁধায়ঃ।।যে দিন বাতি নিভে যাবে ভাবের সহর আন্ধার হবে শুক পাখি সে পালাইবে ছেড়ে সুখময়ঃ।।সিরাজ সাঁই বলে রে লালন স্বরুপ রুপে দিলে নয়ন হবে রুপের রুপ দরশন পড়িস নে ধাঁধায়ঃ”।।সেখানে আমার মনের কথা বুঝেই যেন মোক্ষম এক ঠেস দিলেন লালন, “রতির গিরে ফকসা (ফসকা) মারা শুধুই কথার বেবসা করা...”।কথার ব্যাবসা তো আমি/আমরা করি-আকাদেমিক ট্রাইবের সদস্যরা।‘চালকলা বাঁধা বিদ্যে’আমাদের।ভাষাতত্ত্বের কাজ তো ভাষাকে খন্ড খন্ড করে দেখা- সেটা আমার মতো কথা-বনিকের বিদ্যে ব্যাবসা।এই জায়গা থেকে কি ‘নিঃশব্দে শব্দেরে খাবে ধরা যাবে?’কথার ওপর কথা-বকবক করার ওপর বকবক করা তো ভাষাতত্ত্বের দস্তুর।ভাষাতত্ত্ব তো meta/অধি-বকবক শাস্ত্র,যেখান থেকে নিঃশব্দে.........নাহ,আরেকটা গান ধরেছেন তিনি, (লালন সাঁই-এর গান ৪১৫)-

“মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

সর্বসাধন সসিদ্ধ হয় তার।।

নদী কিংবা বিল বাওড় খাল সর্বস্থানে একই রে জল

একা মোর সাঁই ফেরে সর্ব ঠাঁই মানুষে মিশে হয় সতন্তর (স্বতন্ত্র)।।

নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে আকার সাকার রুপ ধরে সে

যে জন দিব্যজ্ঞানী হয় সেহি জানিতে পায়

কুলি যুগে হয় মানুষ অবতার।।

বহুতর্কে দিন বয়ে যায় বিশ্বাসে ধন নিকটে পায়

সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে

কুতর্কের দোকান খুলিস না রে আর”।।

‘কুতর্কের দোকান’ কী?এই যে আমরা সব সকাম প্রবৃত্তিমূলক কর্ম করি সংসদ-বিধানসভা থেকে এই আকাদেমিক সেমিনার পর্যন্তঃ এসব কি কুতর্কের দোকান?এ দোকান বড় সশব্দ;এখানে ‘টাকা’ নামক ‘চিহ্ন’-ময় বিনিময় বন্দোবস্ত আছে।লালন কি এইসব দোকানদারিকে বাতিল করছেন?আমি ভিখিরি গায়কটাকে আমার সমস্ত অহং-কার দিয়ে পাকড়ালুম,বল্লুম, “টাকা দেবো,তুমি আমায় বোঝাও সব কিছু”।কিন্তু ও ব্যাটা বলে কিনা “ট্যাকায় সব কিছু হয় গো রসিক!তুমি আমাদের আখড়ায় এসো বরং সেখানে সব শুনবে বাবু”।

       এই ভিখিরিটা আমার এন্ট্রি-পয়েন্ট।রাষ্ট্র-সদাগর-পোষিত (ফান্ডেডস্পনসরড ইন্সটিটিউশনালাইজড অরগানাইজড) এক বিজ্ঞানকর্মী এক কৌমের গোপন খবর সন্ধান করতে সেঁধোচ্ছে-‘ওদের’ শরীরে সেঁধোচ্ছে।‘কল্যাণকামী’ রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিকতা এতে লাগু করা যাবে-সর্বত্রসঞ্চারী হবে রাষ্ট্র!

০৩/০২/২০০৩

       প্রথমেই খেলুম ধমকানি।দোষের মধ্যে দোষ,বলেছিলুম, “দেহতত্ত্বের গান হয়ে যাক কয়েকটা”।তাও আবার গাঁজা-সুবাসিত আখড়ার মধ্যে এমন আবদার করে ফেলেছি।আমার মতে তখন একটাই উপায় কাজ করছেঃকড়ি ফেলবো,তেল মাখবো-টাকা দিয়ে সব কিছু করা যায়।আর ওঁরা বলছেন অন্য কথা, “দেহতত্ত্বের সাঁট তুমি কি জানো/বোঝ হে?পয়হা ফেলে গান শুনতে হলে তো তোমাদের যন্তর আছে-সেখানে শোনো না বাপু।আর ট্যাকার কথাই যদি কও তো,আমাদের ভেন্ন টাকশালে যে কথা চিহ্ন আছে,যে শরীর আছে,তা না জেনে তুমি কি করে বুঝবে বাপু নীর-ক্ষীর,ত্রিবেণি,ছ চাকা,লালমোতির মানে?বলতো দেখি লালমোতি তোমার শরীরে কোথায় আছে,সেখানে কেমন বাতি জ্বলে জলের মধ্যে?শরীর ভান্ডে ব্রেহ্মান্ডের খপর জানো কি?”

       এসব প্রশ্নে বিব্রত হয়ে আমি পালটা চাল দিলুম, “আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো।তার আগে গাঁজা খাওয়া বন্ধ করুন।পয়সা দিচ্ছি,খাবারদাবার আনান,খাইদাই।তারপর............”

       এবার এক বাউল হো হো করে হেঁসে অবলীলায় গাঁজার দম ছেড়ে বললেন, “ গঞ্জিকা মানে ঞ্জানযোগ,জানো কি?”এবার তক্কাতক্কি শুরু হবে,আমি সিগ্রেট ধরাই ঈষৎ টেন্সিত হয়ে,এমন সময় সৌম্যকান্তি এক বাউলের প্রবেশ।তিনি বোধয় আবডাল থেকে সব শুনছিলেন,তিনি এসেই বললেন, “ গাঁজায় আপত্তি তো হবেই তোমার।কলোনির সন্তান তো!সাহেবি সিগ্রেট খেতে আপত্তি নেই,অথচ গাঁজার ঞ্জানযোগে আপত্তি।আমি যদি বলি,সাহেবরা ষড়যন্ত্র করে ইন্ডিয়ান হেম্প ড্রাগস কমিশন বসিয়ে গাঁজা খেলে পাগল হয় মানে ক্যানাবিস সাইকোসিসের উদ্ভট তত্ত্ব প্রচার করে ওদের দেশের বার্ডস আই সিগ্রেট আমাদের দেশে চালু করেছিল।।এই ষড়যন্ত্রের ইতিহাস লিখছে অমিত।পড়োনি বুঝি?”না আমি এসব পড়িনি।কিন্তু,আমার বিষয় গাঁজা নয়,শরীর তথা দেহতত্ত্ব।অতএব আমি ফের ব্যাপারটা কনটেক্সয়ুচুয়ালাইজড করার চেষ্টা করি।উনি আপন মনে বলে ওঠেন, “ হিমাচলে থাকার সময় গাঁজা খেতুম বটে।পুলিশ ধরেছিলো,কিন্তু শরীরের রক্তটক্ত পরীক্ষা করে ঞ্জানযোগ গঞ্জিকার হদিস করতে পারেনি পশ্চিমী শরীরতত্ত্বের যন্ত্রপাতি।তোমরা তো বাপু ফিজিওলজি-অ্যানাটমি করো-কলোনির সন্তান,তোমরা এসব অ-যুক্তির পরিসর বুঝবে কি করে?আমাদের ট্যাকশাল আর তোমাদের টাকশাল যে মিলবে না বাপু”।

         আমি বললুম, “ এক টাকশালের ব্যাপারটা কী?”

      -তোমাদের টাকা চিহ্ন দুটো অসম জিনিসকে সমান করে।তুমি বলবে,আমার একটা গান ইজ ইকোয়াল টু পাঁচ টাকা।এটা তোমাদের অসমানকে সমান করার মেটাফিজিক্স।কিন্তু এর থেকে অযৌক্তিক আর কি আছে বাপু?টাকা চিহ্নে তোমরা চল,ভাবছো তাতেই জগৎ চলে;তুমি তো ভাষাতাত্ত্বিক,চিহ্নের অবাধতা বোঝ তো,অথচ নশ্বর কথা ভেঙে ভেঙে কী-সব অপিনিহিতি-অভিশ্রুতি বের করো।হুঁ,তুমি আবার দেহতত্ত্ব বুঝবে।আর দেহতত্ত্ব না বুঝলে এসব গানের মানে না বুঝে বিলাইতি মাল খেয়ে ‘ওরে ভোলা মন’ করে গাঁজা ফুঁকে নাচন কোঁদন করবে।ফোটো বাপু এখান থেকে।আগে সাধনার পথে শরীর বুঝে এসো,তার পর সিরাজ-লালন বুঝবে”।এই বলে তিনি গান ধরলেন, (লালন সাঁই-এর গান ৩৩৪)-

“আপনারে আপনি চিনিনে

পর যার নাম অধর তারে চিনব কেমনে।।

আপনারে চিনতাম যদি মিলত হাতে অটল নিধি

মানুষের করণ হত সিদ্ধি শুনি আগম পুরাণে।।

আত্মরুপে রুপের অন্বেষণ নৈলে কি হয় রুপ নিরুপন

আপ্ত পায় সে আদি ধরণ সহজ সাধক জেনে।।

দিব্যজ্ঞানী যে জন হল নিজতত্ত্বে নিরঞ্জন পেল

সিরাজ সাঁই কয় লালন র’লো জন্ম অন্ধ মন গুণে”।।

শেষ দুই লাইনে খটকা লাগলো,কেননা উনি গাইলেন, “দিব্যজ্ঞানী যে জন হল নিস্তব্ধে নিরঞ্জন পেল”।লালনের পুঁথিতে তো দেখছি “নিজতত্ত্বে”-এখানে ‘নিস্তব্ধ’ এল কী করে?

১৫/০২/২০০৩

          সেদি বড়ো আঁতে ঘা লেগেছিলো।আমার মতো ল্যাজামুড়ো ধারীকে তাড়াবার আস্পর্ধা পান কী করে ওঁরা?আমি ছোড়নেবালা নই-আমি এখন বীরভূম-মুর্শিদাবাদ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।আমিও এক ধান্দাবাজী বের করেছি ওঁদের ধান্দাবাজীর মতন।যেসব বাউলের সঙ্গে দেখা হয়,তাঁকেই জিজ্ঞেস করি, “জয়গুরু,শরীর কেমন?”যাঁরা শরীর খারাপ-ভালোর স্থূল উত্তর দিতেন,তাদের সঙ্গে সংলাপ চালাইনি।এ আমার মাঠকম্মের চাতুরি।আবার দেখা হল সেই সৌম্যকান্তির সঙ্গে।যথারীতি সেই একই প্রশ্ন করলুম।আমার এমন চাপানে ওঁর সহাস্য উত্তোরঃ (লালন সাঁই-এর গান ৩৯১)-

“মনের লেংটি এটে করো ফিকিরি

আমানতের ঘরে যেন হয় না চুরি।।

এদেশে দেখি সদায় ডাকিনী বাঘিনীর ভয়

দিনেতে মানুষ ধরে খায় থাকবে হুসিয়ারি।।

বারে বারে বলি রে মন করবে কঠিন আপ্ত সাধন

আকর্ষণে দুষ্টে মারো ধরি ধরি।।

কাজ দেখি বড় ফোঁড়ে নেংটি তোমার নড়ভড়ে

খাটবে না রে লালন ভেড়ে ট্যাকশালে চাতুরী”।।

এই দু লাইন শুনিয়ে উনি বললেন,দেখ বাপু,বাউল-হওয়ার আগে বামপন্থী রাজনীতি করতুম।একটু আধটু মার্ক্স সাহেবকে পড়েছি তখন।প্রাক-ক্যাপিটাল পর্বের মার্ক্স টাকা-চিহ্নের নশ্বরতা ধরে ফেলেছিলেন।ওঁর পূর্বসূরী গ্রীক সিনিক দার্শনিকরাও (তাঁরা সব ক্রীতদাস-সন্তান) ঐ কয়েনেজকে ডিফেস করতে চেয়েছিলেন।মনে রাখিস,মার্ক্সের পি.এইচ.ডি. থিসিস গ্রীক সুখবাদী দার্শনিকদের নিয়ে করা।তোরা তোদের অবাধ নশ্বরতায় টাকা-চিহ্ন নিয়ে কারবার করিস,তার উলটো কথাই বলি আমাদের ট্যাকশালে।আমাদের এই বোলে সব উলটো।সেই সব উলটো কথা না হয় তোকে বোঝাবো-আমার শরীরটা কেমন সেটাও বোঝাবো।কিন্তু,তোর ধান্দাটা কি বলতো?তোর প্রশ্নের চাতুরী তো আমি ধরে ফেলেছি।রাষ্ট্র আর সদাগরকে আমাদের হাঁড়ির খবর দিবি বুঝি?

      এমন প্রশ্নের মুখে পড়ে আমি গড়্গড় করে আমার ধান্দাটা বলে ফেলি।উনি সব শুনে বলেন, “আমাদের ট্যাকশালের সিদ্ধরা তোদের ট্যাকশালে যাবেন না।গেলেও কিছু ধরতে পারবি না।স্ক্যান করে যেসব ছবি তুলবি,সে-সবও তোর মানুব-ইন্দ্রিয়ের সীমাতে আটকে থাকবে।মানব-বিষয়ী তো তা ইন্দ্রিয়ের সীমা লঙ্ঘন করতে পারবে না।যতই সে বড়াই করে বলুক না,আমি Objective truth পেয়েছি,ততই সে তার বিষয়িতা বা Subjectivity-র সীমায় আটকে যায়।এবার যেসব প্রতিবিম্বই তোল না কেন আরশিতে ডান-বাঁ এদিক-ওদিক হয়ে যাবে বিম্ব।আর দেখবি তো তুই মানুষ!এবার উলটো সড়কে চললে দেখবি,জাগা হয়ে যাবে ঘুমানো,জাগার সত্যি হয়ে যাবে মিথ্যে।ছেলে হয়ে যাবে মেয়ে বা উলটোটা;জড় হবে চেতন,চেতন জড়;বিষ অমৃত,অমৃত বিষ............শুনবি সেসব ‘অ-যৌক্তিক’ কথাবার্তা”।

-আপনি এসব বলে দেবেন?

-হ্যাঁ এটা আমার বিজ্ঞান মন্দিরের কাছে চ্যালেঞ্জ।অর্গানাইজড প্রাতিষ্ঠানিক আলোকপর্বের ‘বিজ্ঞান’-এর বাস্তুমুখী সত্যসন্ধিৎসা কী করে আমার শরীরে সেঁধোয়,সেটা দেখে নেবো।

-আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর আপনি খুব খাপ্পা মনে হচ্ছে।

-ম্যানহাটন-প্রজেক্ট পরবর্তী বিজ্ঞান খেলনা বানিয়েছে,বানিয়েছে মারণাস্ত্র,লুটেপুটে নিয়েছে প্রকৃতির ভাড়ার।এই পরিসর নিসর্গনাশক।সসদাগরের ইচ্ছেয় রাষ্ট্রের টাকশাল থেকে টাকা-চিহ্ন আসে বিজ্ঞানের আজব কল চালাতে।এটি হিংসক,মারক ও চাতুরির (বুদ্ধিমত্তা নয়) পরিসর।

৩১/০৮/২০০৩

[বিগত পাঁচ মাস যাবৎ ওঁর কাছে বসে লালনের গান ধরে ধরে টীকা-ভাষ্য-বার্তিকের স্বদেশী সৌধ মেনে,কবীর-দাদূ-রজ্জব-এর এমন কী উপনিষদ ও ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় ও অভিনব গুপ্তের তন্দ্রালোক ধরে ধরে যেটুকু বুঝতে পেরেছি,তার প্রত্যাভিজ্ঞাজাত বা স্মৃতিস্থ নোটস-এর খানিকটা অংশ আপাতত তুলে ধরলুম।পুরোটা বলতে গেলে পাতার পর পাতা লিখতে হবে।তাই শুধু নিঃশব্দের শব্দ-খাওয়ার গপ্পোটা যাতে বোঝা যায়-সেটু্কুই এখানে বললুম।]

খেপ-১

     উনি আমার সড়কের পথটা চেনেন ভালোই।পৈতে খোয়ানো জাত বামুন এবং কলোনি-জ্ঞানে আকন্ঠ নিমজ্জিত।তার ওপর বকবক করার ওপর বকবক করা আমার পেশা।যে অধিকরণে আমার আপাত আধার তৈরী হয়েছে,সেখান থেকেই শুরু করলেন তিনি।

     বিশেষ উদ্দ্যেশ্যে রচিত পাণিনির ‘শব্দানুশাসন’ (পতঞ্জলির দেওয়া অভিধা) থেকে খন্ডজ্ঞানী ভাষাতত্ত্বের সড়ক যেভাবে চলেছে তা ঠোক্কর খেল ভর্তৃহরিতে এসে।ভর্তৃহরিকে ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন করে পড়া মুশকিল,বিশেষত বেদন্তে জ্ঞান ছাড়া বোঝা যাবে না;দ্বিতীয়তঃ ভাববাদী বিধায় ভর্তৃহরিকে বর্জন করলেও ঝামেলা আছে-এটাও বুঝলুম বেশ কষ্ট করে।

      ভর্তৃহরি ভাষাকে খন্ড খন্ড করে কেটে দেখার বৈয়াকরণিক প্রক্রিয়াকে বলেন অপোদ্ধার (অপ+উদ্ধার; Analytical abstraction)-ওটা বালবাচ্চাদের খেলা (বালানামুপলালনা)।আগে আমরা কথা কই,তার পর তাকে বিশেষ অভিসন্ধিতে কেটেকুটে দেখি,নাম দিই ‘প্রত্যয়’, ‘ধাতু’ ইত্যাদি।একে বলে অন্বাখ্যেয় (অনু [পরে]+আখ্যেয় [আখ্যা বা নাম দেওয়া-বর্গমালা তৈরী করা])তাঁর মতে এটা ‘অনিত্যজ্ঞান’।এতে কি মোক্ষ মিলবে?

      ভর্তৃহরি কথা-কওয়ার তিন স্তরী করলেনঃ

      এই যে আমরা জেগে কথা কই-এর নাম ‘বৈখরী’।এই বৈখরীর কথা লালন কয়েছেন বেশ কয়েকটি পদে-

(লালন সাঁই-এর গান ৩৭৩)

“কি কালাম পাঠাইলেন আমার সাঁই দয়াময়।

এক এক দেশে একেক বাণী কয় খোদা পাঠায়।।

যদি একই খোদার হয় রচনা তাতে তো ভিন্ন থাকে না

মানুষের সকল রচনা তাইতে ভিন্ন রয়।।

এক যুগে যা পাঠান কালাম অন্য যুগে হয় কেন হারাম

এমনি দেখি ভিন্ন তামাম ভিন্ন দেখা যায়।।

একেক দেশের একেক বাণী পাঠান কি সাঁইগুণমনি

মানুষের রচিত জানি,লালন ফকির কয়”।।

(লালন সাঁই-এর গান ৩৯৬)

“বিনা কাজে ধন উপার্জন কে করিতে পারে।।

বাংলা কেতাব দশজনে পড়ে,আর্বি পার্শি নাগরী বুলি কে বুঝতে পারে।

বুঝবা যদি নাগরী বুলি বাংলা খানা লও পাশ করে।।

এক পাঠশালায় দশজনা পড়ে গুরুর বাসনা সব সমান করে

কেউ পাছে এসে আগে গেলে পরীক্ষায় চিনা যায় তারে।।

বিশ্বম্ভর সে বিষপান করে,তাড়োয় করে বিছা হজম কাকে কি পারে

লালন বলে রসিক হলে বিষ জীর্ণ করে”।।

(লালন সাঁই-এর গান ৪১৭ বা ২২০)

৪১৭

“পড়ে ভূত আর হস নে মনরায়

কোন হরফে কি ভেদ আছে নেহাজ করী জানতে হয়।।

আলেপ হে আর মিম দালেতে আহাম্মদ নাম লেখা যায়

মিম হরফটি নফি করে দেখ না খোদা কারে কয়।।

আকার ছেড়ে নিরাকারে ভজলিরে আঁধেলা প্রায়

আহাদে আহাম্মদ হল করলি নে তার পরিচয়।।

জাতে সেফাত সেফাতে জাত দরবেশ তাই জানতে পায়

লালন বলে কাঠমোল্লাজি ভেদ না জেনে গোল বাঁধায়”।।

২২০

“না জেনে করণ কারণ কথায় কি হবে।।কথায় যদি ফলে কৃষি তবে বীজ কেন রোপেঃ গুড় বললে কি মুখ মিষ্ট হয় দীপ না জ্বেলে আঁধার কি যায় তেমনি জান হরি বলায় হরি কি পাবে।।রাজায় পৌরুষ করে জমির কর বাঁচে না সে রে সেই কি তোর একরারি কার্য রে পৌরুষে ছাড়িবে।।গুরু ধর খোদকে চেন সাঁইর আইন আমলে আন লালন বলে তবে মন সাঁই তোরে নিবে”।।

এমন কি দদ্দু শাহর একটি পদে বৈখরীর চমৎকার নমুনা আছে।ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় যে মনে মনে কথা কওয়া,তার নাম ‘মধ্যমা’।বৈয়াকরণের দৌড় বৈখরী অব্দি আর আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকের দৌড় মধ্যমা অব্দি।

     আর গাঢ় ঘুমের মধ্যে গুংগা-অবস্থার নাম ‘পশ্যন্তী’।

     এর পরের চতুর্থ ধাপ ‘পরাবাক’- সংজ্ঞাহীন নৈঃশব্দের এলাকা।এঁটো করা যায় না এমন এক ঠাঁই – অনিবর্চনীয়।এটি অভিনব গুপ্তের অবদান।

     এটুকু শুনেই যখন আমি ‘ধ্যুৎ’ বলে একটা শব্দ উচ্চারণ করেছি,তখন উনি বললেন, “আচ্ছা,এই যে তুই সসীম শব্দ দিয়ে অসীম বাক্য বানাস,জেগে থাকা অবস্থায়?কি করে বানাস রে?কি করে অসীম বাক্য বলিস রে?”

     -এতো চমস্কির বৈজ্ঞানিক উচ্চারণ!এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে আপনি ভর্তৃহরিকে মেলাবেন কী করে।

      -মেলাতে তো চাইনি।আমি শুধু খেয়াল করে দিতে চেয়েছি,এই অসীম বাক্য নির্মাণের সৃজন পারঙ্গমতা আমাদের অগম পারের পরাবাকের আভা এনে দেয়।অগম পারের আভাস দেয়।তবে তুই তো এখন বস্তু বাদী-ভাববাদী দ্বন্দ্বে থিতু আছিস।বুঝবি না ব্যাপারটা-ভাববি ভাববাদী চক্করে ফেঁসে গেছিস।কিন্তু মনে করে দেখ ১৫/০২/০৩-এর সাক্ষাৎকারে আমি বিষয় আর বিষয়ী নিয়ে কয়েকটা কথা কয়েছিলুম।ওগুলো পাঁড় বস্তুবাদী বার্টান্ড রাসেলের কথার পুনরাবৃত্তিঃ বিজ্ঞান যত বেশী বস্তুবাদী হতে চায়,তত বেশী বিষয়ী হয়ে পড়েঃ “plunged into subjectivity against its will” এবং “Science is at war with itself.” এটা আমাদের দ্বিতীয় খেপের বোঝা।আগে বলে ফেলেছি তাই এখন লাফ দিয়ে তৃতীয় খেপে চলে যাবো জাগা-ঘুমোনোর তত্ত্বকথায়।

তৃতীয় ক্ষেপ

     উনি গান ধরলেন, (লালন সাঁই-এর গান ৪২৬)-

“এই বেলা তোর ঘরের খবর নে রে মন

কেবা ঘুমায় কেবা জাগে কেবা কার দেখায় স্বপন।।

শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়,নিঃশব্দে কে আছে সদায়

যে দিন হবে মহাপ্রলয়, কে কারে করবে দমন।।

দেহের গুরু আছে কেবা শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা

যে দিন তাই জানতে পাবা, কোলের ঘোর যাবে তখন।।

যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে কোনখানে সে বসে আছে

সিরাজ সাঁই কয় সে না খুঁজে,দিন তো বয়ে যায় লালন”।।

এই বলে তিনি আমার মত পৈতে খোয়ানো বামুনকে মান্ডুক্য-উপনিষদের সড়ক দিয়ে ঢোকালেন কবীরের দোঁহায়,লালনের গানে।বললেন, “ মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়,কে নিম্নবর্গ,আর কে উচ্চবর্গ,এঁদের মধ্যে যে সড়কে চালাচালি চলেছে তা biway traffic।যাকগে চল,লালন পড়ি এবার মান্ডুক্য দিয়ে তোর সড়ক এটাই- হয়তো Politically incorrect বলবে লোকে।কিন্তু,কা গতি!”

       মান্ডুক্য উপনিষদ বলা হল,

      জেগে থাকাটাই মিথ্যাতম অবস্থান দড়িকে সাপ ভাবার মতো ভ্রম-তাই জেগে থেকে বকবক করাও (বৈখরী) মিথ্যাতম।দড়িকে সাপ ভাবার মত ভ্রম-এরই নাম প্রতিভাসিকতা।পুতুলেরও বিম্বন-পট নিয়ে মিথ্যাতম খেলা চলে এখানে।ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা এবং তখন মনে মনে কথা বলাটাও (মধ্যমা) মিথ্যাতম অবস্থান।পুতুল খেলা এখানেও চলে।দড়িকে দড়ি ভাবাটাও ব্যাবহারিক হয়েও প্রাতিভাসিকতম।

       গাঢ় ঘুম বা সুষুপ্তি ‘মিথ্যা’ অবস্থান।পুতুলের ‘আসল’ স্বয়ং ভগবানের এই ভোগস্থানও তাই মিথ্যা।সগুন ঈশ্বরও প্রাতিভাসিক।এখানেই আছে আপাত সঙ্গার্থহীন ‘পশ্যন্তী’।

        মিথ্যার এই তম,তম ভেদ পেরিয়ে আছে পরাবাকের অগম পার,সেখানে (লালন সাঁই-এর গান ৪২৬)

“এই বেলা তর ঘরের খবর নে রে মন

কেবা ঘুমায় কেবা জাগে কেবা কার দেখায় স্বপন।।

শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়,নিঃশব্দে কে আছে সদায়

যে দিন হবে মহাপ্রলয়,কে কারে করবে দমন।।

দেহের গুরু আছে কেবা শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা

যে দিন তাই জানতে পাবা,কোলের ঘোর যাবে তখন।।

যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে কোনখানে সে বসে আছে

সিরাজ সাঁই কয় সে না খুজে,দিন তো বয়ে যায় লালন”।।

এই পারমার্থিকতায় ঈশ্বর নেই।আছে এক মহাসমগ্র।

    উনি বললেন, “দেখ-,কি সহজে লালন ৪২৬ নং পদে জাগা-ঘুমোনোর মান্ডুক্য থেকে পৌঁছে গেলেন ভর্তৃহরিতে”।আমি বললুম,সবই তো বুঝলুম,কিন্তু জাগার মিথ্যাতম,স্বপ্নের মিথ্যাতর আর সুষুপ্তির মিথ্যাকে আমি প্রমান করবো কি করে?দ্বিতীয়তঃ পরাবাকের নিঃশব্দ এসে শব্দের ঘরে বারাম দেবে বা শব্দকে খেয়ে ফেলবে এটা বুঝবো কি করে?তৃতীয়তঃ এসব করে হবেবাইটা কী?এসব সাধনার লাভ কী?

     প্রথম প্রশ্নের উত্তরঃ কালিদাল ভট্টাচার্যের মান্ডুক্যোপনিষদের কথা বলে ৪ টাকা দামের একটা কিতাবে যে ভাষ্য নির্মান করা হয়েছে,সেটা পড়লে সাধ্য (প্রামাণ্য) পথের সন্ধান পাবি;আর সাধনার পথ মিলবে তোর নিজের শরীরের মধ্যেই এক বিশেষ পরিকল্পনায়।তোর দেহভান্ডে ব্রহ্মান্ড কি করে মিলবে,সেটা কইবো চতুর্থ খেপে।তৃতীয়তঃ এই সাধনায় পথের শুরুই হচ্ছে জগৎ কল্যাণের জন্য-পরম সত্রুরও শুভ কামনা করে।অগমপারের এক মহাসমগ্রে থিতু হয়ে আপন-পর গুলিয়ে দিয়ে যখন ভাববি,সবটাই আমি,তখন মজা হবে দারুণ!তোদের টাকশালে তো মজা নেই,আছে টেনশন,ডিপ্রেশন............

চতুর্থ খেপ

     ধরে নেওয়া যাক একটা মনোকল্পনা।আমার ঘর বা শরীরের ভেতরেই আছে ৬(+২)টি চাকা (দেহের মানচিত্রের ছবি দেখুন)।তবে বন্ধনীভুক্ত দুই-এর একটি বাইরে-ভেতর (inside-out,outside-in)এই আট নং চাকাটি নিয়ে এখানে কিছু বলবো না।মন্দির-স্থাপত্যে নিদর্শন পাওয়া যায় বটে,কিন্তু এখানে আলোচনা করতে গেলে মুখরো হিসেবে কতকগুলো কথা পাড়তে হবে,তাই ছয়+এক চাকার কথাই বলবো।এই ছয় চাকায় উলটানো বদ্ধ পদ্ম আছে।তাদের পাপড়ি সংখ্যা নির্দিষ্ট।তাদের রঙ আছে।নির্দিষ্ট ‘লোক’ আছে।

    এই ছয় +এক চাকার অবস্থান তিন নাড়ীর বিভিন্ন অংশে।তিন নাড়ীঃ (কোনো কোনো বাউল বলেন,যেমন লালন বলেন ‘ত্রিবেণি’)ইড়া,সুষুম্না,পিঙ্গলা।দেহের বাঁ দিকে ইড়া,ডান দিকে পিঙ্গলা।

    এই তিন নাড়ীর নিম্নস্থ মিলন স্থল মূলাধার চক্র।চার দলের পদ্ম তারপর লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান চক্র।৬ দলের পদ্ম।নাভিতে মনিপুর চক্র।১০ দলের চক্র।হৃদয়ে ১২ পাপড়ির পদ্মওলা অনাহত চক্র।

    কন্ঠে ১৬ পাপড়ির পদ্মওলা বিশুদ্ধ চক্র।

    কপালে ২ পাপড়ির পদ্মওলা আজ্ঞা চক্র।

    একুনে ছ’চাকার ৫০ টি পাপড়ির হিসেব পাচ্ছি,এক বিশেষ তন্ত্রে।বৌদ্ধ তন্ত্রে হিসেবটা অন্যরকম।সেটা লালন পন্থীরা অনুসরণ করেন না বলে এখানে উল্লেখ করলুম না।

           প্রত্যেক পদ্মের পাপড়ি আবার ৫০ বর্ণ (Letters)  দ্বারা চিহ্নিত।এগুলো বৈখরী-নির্ভর অবাধ চিহ্ন মাত্র।মনে রাখার সুবিধের জন্য অং,আং ইং............বং শং যং ইত্যাদি নামকরণ করা হয়েছে।কিন্তু ব্যাপার হল ৫০x২০=১০০০ পদ্মের মস্তিষ্কে যে চাকা আছে,সেই তুরীয় জায়গায় ব্রহ্মরন্ধ্রের কল্পনায় পৌছতে পারলে বা ব্রহ্মরন্ধ্র পেরিয়ে তুর্য-তুর্য (বা তুরীয় তুরীয়)জায়গাটা সাধনায় পথে বুঝতে/পৌছতে পারলে মন্তরতন্তর বা এই স্মৃতিসহায়ক (mnemonic) বৈখরী-নির্ভর অক্ষরমালা মনে রাখার দায় থাকে না।যে সাধনে যপ নেই,তাই তা অজপা-সাধন।মন্তর নেই,ঈশ্বরও নেই।আছে সাধনীয় সড়কঃ ইড়া দিয়ে শ্বাসবায়ুর অবরোহক পূরক,তারপর সেই শ্বাসধারণ বা কুম্ভক এবং পিঙ্গলা দিয়ে আরোহক রেচক।দেহের ভেতর এমন সড়কে আরোহন-অবরোহন করতে করতে,চাকার পদ্ম-পাপড়ি খুলতে খুলতে,কুন্ডলিনী (মূলাধার) সুনির্দিষ্ট কোণ থেকে জেগে উঠে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার সারমস্য তৈরী হয়।লালন বলেন, (লালন সাঁই-এর গান ১২)-

“যে পথে সাঁই চলে ফেরে।।তার খবর কে করে।।সে পথে আছে সদায় বিসম কালরাগিণীর (পাঠান্তরঃ কালনাগিনী [কুলকুন্ডলিনী]।যদিচ সারেগামা...র ৭+১ দিয়েও এই ভেতরের রাগিনীর পর্যায়ক্রম বোঝা যায় আরোহন-অবরোহনে)ভয়ে যদি কেউ কেউ আজগুবি যায় অমনি উঠে ছো মারে বিষ ধায় তার ওঠে ব্রহ্মরন্ধ্রে।।যে জানে উলটা মন্ত্র খাটিয়ে সেহি তন্ত্র গুরু রুপ করে নজর বিষ ধরে ভোজন করে তার করণ রীতি সাঁই দরদী দরশন দিবে তারে।।সেই যে অধরধরা যদি কেউ চাহে তারা চৈতন্যগুনিন যারা গুণ শেখে তাদের দ্বারে সামান্যে কি পারি যেতে সেই কুকাপের ভিতরে।।ভয় পেয়ে জন্মাবধি সে পথে না যায় যদি হবে না সাধন সিদ্ধি তাও শুনে মন ঝোরে লালন বলে যা করে সাঁই থাকিতে হয় সেই পথ ধরে”।।

      কিন্তু শুধু চাকা নেই,আছে আরো ৩+২ গিঁঠ।মূলাধার-স্বাধিষ্ঠানের মাঝে ব্রহ্মা গ্রন্থি;অনাহত-মনিপুরের মাঝে বিষ্ণু গ্রন্থি;অনাহত বিশুদ্ধর মাঝখানে রুদ্র গ্রন্থি;সহস্রারে তুর্য গ্রন্থি,তারও ওপরে ব্রহ্মরন্ধ্রে তুর্য-তুর্য গ্রন্থি।

      খেয়াল করে দেখবার যেটা,তা হল সারমস্য এলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্র নামক দেবতা-অবলম্বন লোপাট পেয়ে অজপায় পৌছে গেলে ঈশ্বরিক কোনো নাম বা রুপ থাকছে না।তখন নিশ্চুপ-নির্বাক অবস্থা.........

পঞ্চম খেপ

     এবার আগের চারটে খেপ জুড়ে দিতে হবে এই ভাবেঃ

১।।(+অ)মিথ্যাতম জায়গার কথা বলা (বৈখরী) আজ্ঞা থেকে বিশুদ্ধ চক্র অব্দি বিস্তারিত।

২।।(+উ)মিথ্যাতর স্বপ্নে মনে মনে কথা বলা (মধ্যমা) আজ্ঞা থেকে অনাহত চক্র অব্দি বিস্তারিত।

৩।।(+ম)মিথ্যা গাঢ় ঘুম (সুষুপ্তি আজ্ঞা থেকে মনিপুর/স্বাধিষ্ঠান অব্দি বিস্তারিত।

[+অ+উ+ম=ওঁ।প্রচলিত বৈখরী অক্ষর দিয়ে চেনা যায় এদের।কিন্তু অগম পারে এই ‘অক্ষর’ প্রচলিত অর্থে থাকে না।সেটা উলটে বলে অ-ক্ষর-এর ঠাঁইঃ যার ক্ষরণ নেই।এই শেষ পর্যায় ওঁ-কার ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে মূলাধার অব্দি বিস্তৃত।]

৪।।(-অ-উ-ম)জাগা নয়,স্বপ্ন নয়,গাঢ় স্বপ্নহীন ঘুম বা সুষুপ্তি নয়।মন্ত্রহীন-ঈশ্বরহীন অজপা সাধন।এখানের অক্ষরে যে ক্ষরণ হয় তাতে পরাবাক জেগে/ঘুমিয়ে উঠে/পড়ে।বৈখরী-পশ্যন্তীর চিহ্ন লোপাট পায়।

             [সংলগ্ন চার্ট দ্রষ্টব্য-পুরো ব্যাপারটা এক লপতে ধরা যাবে]

      এমতাবস্থায় পরাবাকের নিঃশব্দে শব্দেরে খায় নীর-ক্ষীর (স্ত্রী-পুং)এক হয়ে যায় (লালন সাঁই-এর গান ৬৭)

“নীচে পদ্ম চরকবানে যুগল মিলন চাঁদচকোরাঃ।সুসঙ্গে কমল কি রুপে হয় প্রেমযুগল জান না হলি কেবল কামাবেশে মাতোয়ারাঃ।।স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গ নহি নহি নপুংসকো সেহি যে লিঙ্গ ব্রহ্মান্ডের উপর কি দিব তুলনা তাহার রসিক জনা জানছে এবার অরসিকের চমৎকারাঃ।।সামর্থারে পূর্ণ জেনে বসে আছে সেই গুমানে যে রতিতে জন্মে মতি সে রতির কেমন আকৃতি যারে বলে সুধার পতি ত্রিলোকের সেই নেহারাঃ।।শোনি’ শুক্ল চম্পক কলি কোন স্বরুপ কাহারে বলি ভৃঙ্গ রতির কর নিরুপণ চম্পক কলির অলি যে জন ভাবানুসারে কহে লালন কিসে যাবে তারে ধরাঃ”।।

আমার ঘরের চাবি আর পরের হাতে থাকে না।‘আমি’ পরবশ না হয়ে আত্মবশ হয়।লালন আরো বলেন, “... ... শব্দের ঘরে নিঃশব্দের কুড়ো সদাই তারা আছে জুড়ে দিয়ে জীবনের নজরে ঘোর টাটি”।আমার বাইরের ঘর বকবক করার সশব্দ জাগ্রৎ জগৎ।সেই বাইরের ঘরের ভেতরে আছে নিঃশব্দের কুড়ে (লালন সাঁই-এর গান ১৪০)-

“খুজে ধন পাই কি মতে পরের হাতে কলকাঠি।।শতেকো তালা মালকুঠি।।শব্দের ঘর নিঃশব্দের কুড়ে সদাই তারা আছে জুড়ে দিয়ে জীবের নজরে ঘোর টাটি।।আপন ঘরে পরের কারবার আমি দেখলাম না রে তার বাড়িঘর আমি বেহুস মুটে কার মোট খাটি।।থাকতে রতন ঘরে একি বেহাত আইজ আমারে লালন বলে রে মিছে ঘরবাটি”।।

অথবা লালন বলেন,

“সে কখনও কোন খেয়ালে থাকে কিছুই না জানা গেলঃ।সাধুরো জবাবে শুনি ধরাতে আছেন ধনী কথা কয়না গুণমনি আওয়াজ শুনি চেনা বিষম দায় হল ভেবে লালন বলে ম’লাম ঘুরে মানুষ সত্য যা হলঃ”।।(লালন সাঁই-এর গান ১৩৭)

     একশত কথা কওয়ার পর ওনি বললেন, “ এবার কি নিঃশব্দের ভাষাতত্ত্ব নিয়ে মানে না-বকবক নিয়ে আরো বকবক করবি?নাকি চেপে যাবি?”আমি একবার উত্তর দিই নি।কিন্তু পরপর দুটি পদ বললেন-একটি কবীরের,অন্যটি দাদূর-যার সঙ্গে এই লালন পরিক্রমার একাধিক অনুষঙ্গ তৈরী হলঃ

মুকখ বাণী তিকো স্বাদ কৈ সে কহৈ

স্বাদ পারৈ সোই মকখ মানৈ।

কহৈঁ কবীর য়া সৈন গূঁগা তঈ

হোই গূঁগা জৌই সৈন জানৈ।।

“মুখ্য সেই বাণী,তাহার স্বাদ কেমন করিয়া বলা যায়,যে স্বাদ পাইয়াছে সেই জানে আনন্দ কী?কবীর কহেন,তাহা জানিলে মূর্খই হয় জ্ঞানী এবং জ্ঞানী তাহা জানিয়া হইয়া যায় নির্বাক”।(তর্জমাঃ ক্ষিতিমোহন সেন)।

      পরেরটি দাদুর উক্তিঃ “ তিনি মৃতও নন,জীবিতও নন,তিনি আসেনও না যানও না,তিনি সুপ্তও নন,জাগ্রতও নন,তিনি বুভুক্ষিতও নন,খানও না।(তুলনীয়ঃ ঈশোপনিষদ,মন্ত্রঃ৫)/সেখানে চুপ করিয়া থাকো কথা কহিয়ো না,সেখানে না ‘আমি-তুমি’ প্রভৃতির বালাই নাই;হে দাদু,সেখানে না আছে আপন না আছে পর,না আছে ‘এক’,না আছে ‘দুই’।/এক বলি তো থাকে দুই,দুই বলি তো থাকে এক,তাই তো দাদু হইল দিশাহারা;তিনি যেমন আছে তেমনই দেখো”।এমন তর্জমা করার পর ক্ষিতিমোহন সেন চমৎকার একটি ভাষ্য জুড়েছেনঃ “তত্ত্ববাদীদের সুবিধা করার জন্য সেই লীলার রসটি যে একপেশে হইয়া মাটি হয় নাই,ইহাতে,রসিক পরিতৃপ্ত,যদিও দার্শনিক হইলেন হতাশ”।দর্শনের পথে এমন ১-২ গোলানো অবস্থাকে বলা হবে ভেদাভেদ-identity in difference.আমি দর্শনের পথে চলার চেষ্টা করেছিলুম,রসিক হতে পারি নি,কেননা আমি দায়ে পড়ে এঁদের শরীরে সেঁধোতে এসেছিলুম-অর্থাৎ দায়িক হিসেবে এসেছি ফকির বা কাঙাল হিসেবে আসিনি।কিন্তু,এতশত কথার পর আমার ফান্ডেড রিসার্চ গেল গুলিয়ে।এই সাধনায় দীক্ষিত হয়ে নীরবতার ভাষাতত্ত্ব রচনা করে পদোন্নতি করা আর হল না।নিষ্কাম নিবৃত্তিতে আরোহন-অবরোহন যখন প্রাণের মধ্যে হাওয়া বওয়াচ্ছি,তখন রবি ঠাকুরের একটা গান মনে পড়লো, “আজি মর্মরধ্বনি কেন বাজিল রে”।উনি আমায় ঠিক করে দিলেন;বললেন, “ধ্বনি তো বাজেই,কিন্তু এখানে রবি ঠাকুর ‘বাজিল’ ক্রিয়া ব্যাবহার করেন নি”।এই বলে গান ধরলেন, “আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে”।ধ্বনি বাজছে না, জাগছে-ভেতর থেকে আপাতত-আমার হৃদয়কমল-দল খুলছে।আহত ধ্বনির বিশুদ্ধ চাকার বৈখরী –নির্ভর ভাষাতত্ত্ব থেকে অনাহত চাকার হৃৎকমলে না-আহত ধ্বনি ‘জাগছে’ আমার আপাতত......এখন আর কোথায় ভাষাতত্ত্ব,নামখ্যাতি,সেমিনার পদমর্যাদা ইত্যাদির মোহ বা সকাম প্রবৃত্তিমূলক কর্ম.........আমার কর্মবিরতি আসছে.........তার মানে এই নয় যে এখন আমি অন্যের সারপ্লাস লেবার ঝেড়ে খাবো-কবীর তাঁতির মতো আমার জামা আমায় বুনতে হবে,দাদু মুচির মতো আমার জুতো আমায় বানাতে হবে,লালনচাষার মতো নিজের খাবার নিজেই তৈরী করতে হবে।

    সেই আবশ্যিক শ্রম (necessary labour)সেরে ‘রসিক’ হবার অফুরন্ত সময় পাওয়া যাবে খন।আবার দরকার পড়লে মহর্ষির লেঠেলদের বিরুদ্ধেও কাঙাল হরিনাথকে সাথি করে লড়ে নেওয়া যাবে – “কাঙাল মোরে কাঙাল করেছো......”

[এখানে ধ্বনি-নাদ-বিন্দু ও অক্ষরের বিশেষার্থ আছে।প্রবন্ধান্তরে এবিষয়ে আলোচনা করা যাবে।]

০১/০২/২০০৬

ওরা আমায় ধরে এনেছে ল্যাবের ভেতর।ওরা আমার শরীরে সেঁধোতে চায় যন্ত্ররপাতি দিয়ে।ধমনীর মধ্যে দিয়ে ক্যাথেটার চলে গেছে আমার মস্তিষ্কে।অনবরত আঘাত করছে পজিট্রন আর ফোটন......নানান আইসোটোপস।উনি আপ্তসাবধানী।উনি বলেছিলেন, “আপন সাধনকথা,না কহিবি যথাতথা।আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান”।আমি ওঁর কথা মনে রেখেছি।তুলুক না ছবি (বিম্বন)যত পারুক।মানবইন্দ্রিয়ের সীমা দিয়ে সে ছবির বিশ্লেষন আর কতটুকুই বা ওরাআ করবে।পটের বিম্বনে কি ‘আসলি’(?)চিজ মিলবে?ইন্দ্রিয়ের ‘দেখা’ আর মানবমনের ‘বোঝা’-র (প্রত্যয়,understanding)মধ্যে হারমেনেয়টিক ফাঁক থেকে যায় তো!

     এক সময় ওঁদের পট-বিম্বন থেমে গেল,মনিটরের স্ক্রিন ঝিরঝির করতে করতে সাদা হয়ে গেল......শূন্যতা!স্ব-ত্ব হারিয়ে আমার নিঃ-স্ব-ত্ব ধরার যন্তর ওদের হাতে নেই।

     আমার চুপসাধনায় ওদের অ্যানাটোমো –বায়ো পলিটিকাল তকনিকি কারিকুরি কাজ করবে না।ওদের Will to know মানে তো Will to power!আমি আমার আমিকে কীভাবে অবাদ করবো (care of self) তা তোমার জানার দরকার কী হে সদাগর-পোষিত রাষ্ট্রশাসিত ‘আধুনিক’ বিজ্ঞান?

টীকাঃ ১)চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ে যে সিদ্ধাচার্যরা পৌছে যান,তাঁরা এক বিশেষ সম্পর্কে থিতু হন।সেই সম্পর্কের নাম ‘সমবায়’।এক ধরনের সম্পর্ক হয়,যা সহজে বিচ্ছিন্ন করা যায়-নাম তার ‘সংযোগ’সন্নিকর্ষ।যেমন,আমার হাতের পেন আর এই কাগজের সম্পর্ক ‘সংযোগ’,কিন্তু,পাতার সঙ্গে পাতার কম্পনক্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা যায় কি?সমবায় এমনই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কঃসমস্ত ব্রহ্মান্ডে মানুষ ও না- মানুষ-সবাই একই ‘আমি’ (আত্মন),এ এক মহাসমগ্র।তবে এই জায়গায় নুনের পুতুল নুনের সমুদ্রে মিশে গেলেও,আবার ফেরৎ আসেন লোকসংগ্রহের জন্য।

২)এখানে কতকগুলো undecidable decidable  ব্যাপার non-contradictory condrictions (APORIA) আছেঃ জাগা-ঘুমানো,অক্ষর-শব্দ-নাদ-বিন্দু ইত্যাদি শেষ অব্দি উল্ট সাধনের ধাঁধায় পড়ে।এনিয়ে বারান্তরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

কৃতজ্ঞতাঃ

   কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য,ক্ষিতিমোহন সেন,কালিদাস ভট্টাচার্য,শশিভুষণ দাশগুপ্ত,মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ,কার্ল মার্ক্স ও মিশেল ফুকো।গাঁজা বিষয়ক মন্তব্যের ক্ষেত্রে ডাঃ অমিতরঞ্জন বসুর কাছে আমি ঋণী।তার লেখা নিবন্ধ, “ গঞ্জিকা আর গ্রাসঃ একটি আধুনিক গাঁজাপুরাণ”বেরিয়েছিলো অবভাস,২০০৪ এর অক্টোবর-ডিসেম্বর-এ।আমার এই গবেষণার দস্তাবেজ সংগ্রহ করেছে এশিয়াটিক সোসাইটির সুচন্দ্রা চৌধুরী।তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝাড় তাগাদা ও তাঁর সঙ্গে নিরন্তর সংলাপ না চালালে এই লেখাটা হয় তো কোনোদিন হয়েই উঠতো না।নিবন্ধে উল্লেখিত লালন সাঁই-এর গান (কবিতাপাক্ষিক ২০০৫)তাঁরই লেখা।