বাউল/Baul

in Article
Published on: 17 June 2016

Saymon Zakria

Assistant Director, Folklore department, Bangla Academy and visiting scholar University of Chicago

ভূমিকা : বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ সৃজনশীল সাধকদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই সম্প্রদায় মূলত দেহ-সাধনা করেন এবং গানের মাধ্যমেই সেই দেহ-সাধনার কথা প্রকাশ ও প্রচার করেন। বাউলদের রচিত গানের ভাবের গভীরতা, সুরের মাধুর্য, বাণীর সার্বজনীন মানবিক আবেদন বিশ্ববাসীকে মহামিলনের মন্ত্রে আহ্বান করে। তাই ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বাংলার বাউলগানকে দি রিপ্রেজেন্টিটিভ অব দি ইন্টানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির তালিকাভুক্ত করে। অবশ্য তার আগেই বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশক হতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউলগান ও বাউলদের সাধনপদ্ধতি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। পাশাপাশি বাংলার বাউলগান পরিবেশন করতে গ্রামের বাউল সাধকশিল্পীগণ নানা দেশ ভ্রমণ করেন। তবে, জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পরিমহলে বাউলদের সাধনা ও গান সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবীর তৎপরতায়, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার বাউল ও বাউল সম্পর্কে বিশেষভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এমনকি নিজের রচনার ভাবসম্পদ হিসেবে বাউলগানের ভাবাদর্শ তিনি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর গৃহীত হয়েছিল বাউল গগন হরকার গান হতে। 

 

বাউল সাধনার ইতিহাস ও সাধন-পদ্ধতি : দেহকেন্দ্রিক বাউল-সাধনার সাথে প্রাচীন ভারতীয় সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রের সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে, বাউল-সাধনা মূলত বৈদিক বা ব্রাহ্মণ আচার বিরোধী এবং মৈথুনাত্মক ও রাগানুগা সাধনার পক্ষপাতী। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া ও নাথধর্মের দেহ-সাধনার সাথে বাউল-সাধনার নৈকট্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাহিত্য-সংস্কৃতির নিদর্শন আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত চর্যাগীতির অনেক পদের সাথে বাংলার বাউলদের দেহ-সাধনার প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়। যেমন- চর্যার প্রথম পদেই লুইপা যে দেহ সাধনার কথা বলেছেন, তা হলো- ‘কাআ তরু বর পঞ্চ বি ডাল।/চঞ্চল চিএ পৈঠ কাল॥/দৃঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।/লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জান॥’ অর্থাৎ মানবদেহে বৃক্ষশাখার মতো পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, আর তাদের চব্জলতার জন্য মৃত্যু ধেয়ে আসে। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মহাসুখের দেখা মেলে। লুই বলেন- গুরুর কাছ থেকেই কেবল সেই দেহ-সাধনায় মহাসুখ পাবার কৌশল জানা যায়। এ ধরনের কথার ভেতর দিয়ে দেহ-সাধনার জন্য যে গুরু আবশ্যক সেই নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলার বাউলরা আজও দেহ-সাধনার জন্য চর্যায় বর্ণিত সেই গুরুকেই আশ্রয় করে থাকেন। কিন্তু বাউল-সাধনার পূর্ণাঙ্গ উদ্ভব ও বিকাশ কাল হিসেবে সাধারণত ১৪৮৬ হতে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান চৈতন্যদেবের সময়কে শনাক্ত করা হয়। কথিত আছে যে, চৈতন্যদেবের মৈথুনাত্মক সাধন-পদ্ধতি অনুসরণে আউল চাঁদের শিষ্য মাধববিধি বাউলমত প্রবর্তন করেন এবং মাধববিবির শিষ্য বীরভদ্রের তৎপরতায় এই মতের বিস্তৃতি ঘটে। বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ডক্টর আহমদ শরীফ বলেন, “যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল আর যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দু-সমাজ ভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মাচরণে রত ছিল, তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উল্টরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।”১ 

বাউল সাধনার সাথে যেহেতু নানা ধর্মমতের প্রভাব রয়েছে সেহেতু বাউল গানে হিন্দু প্রভাবে রাধা-কৃষ্ণ, শিব-শিবানী, মায়া-ব্রহ্ম, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি পুরুষ-প্রকৃতির প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, মুসলিম প্রভাবে তেমনি মোকাম, মঞ্জিল, লতিফা, সিরাজম্মুনিরা, আল্লাহ, কাদের, গনি, রসুল, রুহ, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহম্মদ-খাদিজা, আলি-ফাতেমা প্রভৃতি প্রতীকী রূপক গৃহীত হয়েছে। আবার বৌদ্ধ নাথ এবং নিরঞ্জনও পরিত্যক্ত হয়নি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৌরাণিক উপমা ও কুরআন-হাদিসের বাণীর নানা ইঙ্গিত [যেমন বর্জখ]। অবশ্য বাউল রচনায় এসব শব্দ ও পরিভাষা তাদের মতানুগ অর্থান্তর তথা নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। বৈষ্ণব ও সূফী সাধনার সঙ্গে বাউল মতের মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি পরিহার করে যে মিলন-ময়দান তারা তৈরি করল, তাকে সার্থক ও স্থায়ী করার জন্য পরমাত্মা বা উপাস্যের নামেও এক সর্বজনীন পরিভাষা তারা সৃষ্টি করেছে। তাদের ভাষায় ‘পরমতত্ত্ব’ পরমেশ্বর বা সচ্চিদানন্দ হচ্ছেন মানুষ, অটল মানুষ, সহজ মানুষ, অধর মানুষ, রসের মানুষ, ভাবের মানুষ, অলখ সাঁই, অচিন পাখি, মনুরা প্রভৃতি পরমাত্মা- আত্মারই পূর্ণাঙ্গ রূপ। বাউল মতে, দেহস্থিত আত্মাকে কিংবা আত্মা সম্বলিত নরদেহকে যখন ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করা হয়, তখন পূর্ণাঙ্গ বা অখ- আত্মা বা পরমাত্মাকে মানুষ বলতে বাধা থাকে না।  

বাউল সাধনার এই প্রকৃতি বিচারে ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় সতেরো শতকের মধ্যভাগ হতে বাউল মতের উদ্ভব। গুরু, মৈথুন ও যোগ তিনটিই সমগুরুত্ব পেয়েছে বাউল মতে। তাই গুরু, বিন্দুধারণ ও দম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা বাউল গানে অত্যাধিক। সৎগুরুর কাছে দীক্ষা না নিলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা অসম্ভব এবং বিন্দুধারণে সামর্থ্যই সিদ্ধির প্রকৃষ্ট নিদর্শন। বাউল মতে আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। এই দেহস্থিত আত্মাই মানুষ, মানের মানুষ, রসের মানুষ, অলখ সাঁই। বাউলের ‘রসস্বরূপ’ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দস্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস। এটিই আত্মতত্ত্ব। এর মাধ্যমে অরূপের কামনায় রূপ সাগরে ডুব দেয়া, স্বভাব থেকে ভাবে উত্তরণ। সহজিয়াদের ‘সহজ’ই সহজ মানুষ। মৈথুন মাধ্যমে বিন্দুধারণ ও উর্ধ্বে সঞ্চালনের সময়ে গঙ্গা (ইড়া) ও যমুনা (পিঙ্গলা) বেয়ে সরস্বতীতে (সুষু¤œায়) ত্রিবেণঅ (মিলন) ঘটাতে হয়। তারপর সেখান থেকে সহ¯্রায় (মস্তকস্থিত-সহ¯্রদল পদ্মে) যখন বিন্দু গিয়ে পড়ে, তখনই সৃষ্টি হয় মহাভাব বা সহজ অবস্থা। বাউলগণ মূলত সাধনায় সেই মহাভাব অর্জন করেন।

বাউলের শাব্দিক অর্থ ভেদ: বাংলার বাউল, বাউল মত ও বাউল সংগীত তথা বাউল গান নিয়ে নানা জনের নানা মত প্রচলিত। এই মতানৈক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে “বাউল” শব্দটি। আসলে, “বাউল” শব্দটির অর্থ, তাৎপর্য, উৎপত্তি ইত্যাদি নিয়ে অদ্যাবধি গবেষকেরা যেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি, তেমনি “বাউল মত”-এর স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রদান করতে পারেন নি। নানা জনের নানা মত নিয়েই “বাউল মত” বিষয়ে অমীমাসিংত আলোচনা চলছে এবং চলমান থাকবে বলেই আমাদের ধারণা।

বাউল মত ও তার উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কোনো কোনো গবেষক বলেছেন- সংস্কৃত “বায়ু” থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, তাঁদের মতে সংস্কৃত বায়ু= বাঙ্গালা “বাই”, “বাউ” শব্দের সাথে স্বার্থে “ল” প্রত্যয়যোগে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, এই মতানুসারি গবেষকদের ভাষ্যে জানা যায়- বাংলার যে সব লোক “বায়ু” অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সাহায্যে সাধনার মাধ্যমে আত্মিক শক্তি লাভ করার চেষ্টা করেন, তাঁরাই বাউল।২

গবেষকদের কেউ কেউ আবার বলেছেন- সংস্কৃত “বাতুল” শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, প্রাকৃত ব্যাকরণ মতে- দুই স্বরবর্ণের (এখানে “আ” এবং “উ”) মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ (এখানে “ত”) লোপ পায়, আসলে এঁই সূত্রমতেই “বাতুল” শব্দটি “বাউল” হয়ে গেছে, গবেষকদের মতে- যে সব লোক প্রকৃতই পাগল, তাই তাঁরা কোনো সামাজিক বা ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ মানে না, তাঁরাই বাউল।৩ 

বাউল মতের স্বরূপ নির্ধারণের প্রশ্নে গবেষকদের অন্য দল বলেন- প্রাকৃত “বাউর” শব্দ হতে “বাউল” শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে, “বাউর” অর্থ এলো-মেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল। এই দলের গবেষক-মতে, বাংলার বাউলদের মতো একদল বিশৃঙ্খল চিন্তাজীবী লোক উত্তর-ভারতে প্রত্যক্ষ করা যায়, বাংলার বাউল চিন্তার দিক হতে তাদেরই এক গোষ্ঠীভুক্ত। সুতরাং উত্তর-ভারতীয় প্রাকৃত শব্দ “বাউর” বাংলাদেশে “বাউল” শব্দে পরিণত হয়ে থাকবে, কেননা লোকায়ত সমাজে উচ্চারণ-ধ্বনির দিক দিয়ে “র” এবং “ল” বর্ণের সাদৃশ্য থাকায় অনেক ক্ষেত্রে এই দুটি বর্ণ পরস্পরের রূপ গ্রহণ করে থাকে।

আরেক শ্রেণীর গবেষকদের ভাষ্যমতে- “বাউল” শব্দকে “আউল” শব্দের পৌনঃপুনিক অপভ্রংশ বলে মনে করেন, তবে তাঁরা এ কথা মনে করেন না যে “আউল” শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত “আকুল” শব্দ হতে, তার বদলে মুসলমান সাধক অর্থে আরবি “অলী” শব্দের বহুবচন “আউলিয়া” শব্দ হতে “ইয়া” প্রত্যয়ের পতনে উৎপত্তি বলে মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে- বাংলার যে সব লোক মুসলমান দরবেশদের মতো লম্বা আল্খেল্লা পরে, তাঁদের বাণী ও বিশ্বাসে আস্থাপরায়ণ হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাঁরাই বাউল। এই জন্যই নাকি বাউল-সন্ন্যাসীদের “ফকির” বলা হয়।৫ 

গবেষক মুহম্মদ এনামুল হক “বাউল” শব্দের উৎপত্তি ও তার অর্থ সম্পর্কে উপর্যুক্ত নিষ্পত্তিগুলো উদ্ধৃতি দিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, “বাউল সম্প্রদায়ের নাম বাউলেরা নিজে গ্রহণ করে নাই। সাধারণ বাউল-বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করিয়াই, দেশের লোক তাহাদিগকে এই নাম দিয়াছে।”৬

মুহম্মদ এনামুল হকের এই বক্তব্যের সাথে একথা যুক্ত করা অসঙ্গত হবে না যে, বাউলেরা নিজেরা যেহেতু নিজেদের বাউল নামটি দেন নি সেহেতু “বাউল” শব্দটির উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত রয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বাউল মতের মর্মকথা অনুধাবন করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। 

বাউল গানে বাউলের সংজ্ঞা : বাউলের প্রকৃতি সম্পর্কে বাউল গানে নানা ধরনের তথ্য বিবৃত হয়েছে। এ পর্যায়ে বাউল-সাধকের রচিত সংগীতের বাণীকে আশ্রয় করেই বাউল মতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেমন, একটি বাউল সংগীতের বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে-     

 

যে খুঁজে মানুষে খুদা 

সেই তো বাউল

বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে 

পাই তার উল॥

 

পূর্ব জন্ম না মানে 

ধরা দেয় না অনুমানে

মানুষ ভজে বর্তমানে 

হয় রে কবুল॥

 

বেদ তুলসী মালা টেপা

এসব তারা বলে ধুকা

শয়তানে দিয়ে ধাপ্পা 

করে ভুল॥

 

মানুষে সকল মেলে

দেখে শুনে বাউল বলে

দীন দুদ্দু কি বলে

লালন সাঁইজির কুল॥৭

বাংলাদেশের ঝিনাইদহ অঞ্চলের বাউল-সাধক দুদ্দু শাহ কর্তৃক উপর্যুক্ত সংগীতের বাণীতে “বাউল মত” তথা বাউলতত্ত্বের মূল-কথাটা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কেননা, বাংলার বাউলদের মূল পরিচয়ের প্রধানতম একটি দিক হলো- তাঁরা মানুষেই শ্রষ্টার সন্ধান করেন। দ্বিতীয়ত দিক হলো- তাঁরা প্রচলিত ধর্মগোষ্ঠীর লোকদের মতো অনুমানে বিশ্বাস করেন না, এমনকি পূর্বজন্ম বা জন্মান্তরবাদকে মানতে নারাজ; তৃতীয়ত- বেদ তুলসী মালা টেপাকে তাঁরা ধোক্কার কাজ বলে গণ্য করেন। আসলে, প্রচলিত ধর্মীয় চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলার বাউল মত মূলত ‘মানুষে সকল মেলে’ এই তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।

বাউল-গবেষক শক্তিনাথ ঝা তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন- ‘বাউল মতবাদ কোন ধর্ম নয়। সম্প্রদায় কথাটি শিথিলভাবে এখানে ব্যবহৃত হতে পারে। বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠী ও সামাজিক স্তরের ব্যক্তি বিশেষ গুরুর কাছ থেকে এ মতবাদ, গান ও সাধনা গ্রহণ করে নিজ নিজ সামর্থ্য ও সংস্কারানুযায়ী তা পালন করতে চেষ্টা করে এবং এক শিথিল স্বেচ্ছামূলক ম-লী গঠন করে। সাধক আবার গুরু হিসাবে বিশ্লিষ্ট হয়ে পৃথক এক বৃত্ত নির্মাণ করে। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য ও বৈচিত্র্য দুই-ই আছে। বাউল তত্ত্বে এবং সাধনায় প্রচলিত মূল্যবোধ ও আচারকে বিপরীত রূপে আদর্শায়িত করা হয়, প্রচলিত শাস্ত্রবিরোধী সাধনা নানা বৈচিত্র্য-মত রূপে বাউল জীবনচর্যা রচনা করেছে। অলৌকিক ঈশ্বর, দেহব্যতিরিক্ত আত্মা, স্বর্গাদি পরলোকে অবিশ্বাসী বাউল ইহবাদী, দেহবাদী। আর্থ- সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিধিবিধানের প্রতিবাদী মানুষেরা বাউল মতবাদ গ্রহণ করে।’৮ 

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বাউল মতের প্রভাব রয়েছে। তবে, এক এক অঞ্চলের বাউল মত এক এক রকমভাবে বিকাশ লাভ করেছে। যেমন- কুষ্টিয়া অঞ্চলের লালনপন্থী বাউল-সাধকদের সাধনা-পদ্ধতি, জীবনাচার-বেশ-বাস, সাধুসঙ্গ, এমনকি গায়কী ও গানের সুর-বাণী ইত্যাদির সাথে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ইত্যাদি অঞ্চলের বাউলদের তেমন কোনো সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু ভাবের দিক দিয়ে ও সাধনার ঘর হিসেবে দেহকে আশ্রয় করার বিষয়ে কিছুটা মিল রয়েছে। আসলে, সব অঞ্চলের বাউলেরাই সাধনার আশ্রয় হিসেবে দেহকে অবলম্বন করে থাকেন এবং দেহ-ঘরের মধ্যে তাঁরা সৃষ্টি-শ্রষ্টার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন, আর গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রায় সব অঞ্চলের বাউলেরা সাধনার ধারা অব্যাহত রাখেন। এক্ষেত্রে গুরুকে তাঁরা শ্রষ্টার সমতুল্য বিবেচনা করেন। তাঁরা মনে করেন গুরু বা মুর্শিদকে ভজনা করার ভেতর দিয়ে শ্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করা যায়। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরাভেদকে লালন সাঁইজি প্রকাশ করেছেন এভাবে- 

যেহি মুর্শিদ সেই তো রাছুল

ইহাতে নেই কোন ভুল

খোদাও সে হয়;

লালন কয় না এমন কথা

কোরানে কয়॥৯

বাংলাদেশের বাউলেরা এভাবেই অকাট্য যুক্তির আলোকে শরিয়তি গ্রন্থকে সামনে রেখেই গুরুবাদী ধারার সাধনচর্চাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ-গুরু ভজনা এবং মানুষকে সেজদার যোগ্য বিবেচনা করে, তার ভেতর দিয়েই যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট ইবাদত সম্ভব বাংলার বাউল-সাধকেরা সেকথা ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করেন নি।

এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলার বাউল মত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। তাই বাউলেরা বৈষ্ণব, চিশতিয়া প্রভৃতি সাধক-শ্রেণীর মতো কোনো বিশিষ্ট সম্প্রদায় নয়। বৈষ্ণব ও বিভিন্ন শ্রেণীর সুফি মতের অনুসারীরা যেমন তাঁদের প্রতিষ্ঠাতার নাম বলতে পারেন, বাউলেরা তা পারেন না। অতএব, আদি বাউল কে- তা নিয়ে বির্তকের কোনো শেষ নেই।

বাউল-গবেষক শক্তিনাথ ঝা অবশ্য বিভিন্ন গবেষকের সূত্র মিলিয়ে বাংলার বাউল মতের প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত দিয়েছেন চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি সাহিত্য নিদর্শনের উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা সহকারে।১০ তাঁর মতে, বাউলদের আদিগুরুর নাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না গেলেও এ কথা অন্তত বলা যায়- বাংলার ‘বাউল পন্থা কোন অর্বাচীন মতবাদ নয়।’১১ 

বাউলদের স্বরূপ ও পরিচয় দিতে গিয়ে মুহম্মদ এনামুল হক বলেন “বাউল”-দিগকে “বাতুল” অর্থাৎ পাগল বলা হয়। বাউলেরা যাঁহার সন্ধানে পাগল, তাঁহার কোন নাম নাই,- তিনি “অনামক”। তবে তাঁহারা তাঁহাকে যখন যাহা খুশী সেই নামে অভিহিত করে। তাই দেখিতে পাই, তাহারা তাঁহাকে “মন-মনুরা”, “আলেক্”, “আলেখ্ সাঁই”, “অচিন পাখী”, “মনের মানুষ”, “দরদী সাঁই” ও “সাঁই” প্রভৃতি কত নামেই না পরিচিত করিতে চেষ্টা করিয়াছে। এইরূপ যে নামেই তাহারা তাঁহাকে পরিচয় দিক না কেন, তিনি তাহাদের নিকট চিরদিনই “অনামক”। হিন্দুর “ব্রহ্ম”, বৈষ্ণবের “কৃষ্ণ”, বা মুসলমানের “আল্লাহ”-এর ন্যায় কোন একটি বিশিষ্ট নাম আরোপ করা তাহাদের স্বভাব নয়।”১২ একই সঙ্গে সেই পরমসত্তাকে বাংলার বাউলেরা সাধারণ ধর্মাচারী মানুষের মতো তারা ভীতিকর এবং দেহ ও নিজের আত্মগত সত্তার বাইরের বস্তু বলেও মনে করে না। বরং দেহকেন্দ্রিক ষট্চক্র যোগে সাধনায় আত্ম তথা স্রষ্টা দর্শনের অপূর্ব প্রশান্তি খুঁজে ফেরেন। 

বাউলের আঞ্চলিক বৃত্ত : বাংলার বাউলদের আঞ্চলিক সীমারেখা হল বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অব্জল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশপরগণা ইত্যাদি। এই যে বিশাল এলাকা জুড়ে বাউলদের বিস্তার ঘটেছে, তাতে সবখানে একই ধরনের বাউল প্রত্যক্ষ করা যায় না। আসলে, অঞ্চলভেদে বাউলদের বেশ-বাস হতে শুরু করে গানের কথায়, সুরে, এমনকি সাধন-পদ্ধতিতে, করণ-কার্যে নানা ধরনের বৈসাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন রাঢ় অঞ্চলের বাউলদের সাথে মধ্যবঙ্গের বাউলদের অন্তর্গত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। আসলে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া-মুর্শিদাবাদ বা বীরভূম-বাকুড়া অঞ্চলের বাউলেরা বৈষ্ণবপ্রভাবিত, তারা বৈষ্ণবদের মতো যেমন গেরুয়া-হলুদ পোশাক পরিধান করেন, তেমনি গানের শুরুতে বা পরে মুখে বলেন ‘হরি হরি’ বা ‘হরি বোল’; পক্ষান্তরে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ফরিদপুর, মাগুরা অঞ্চলের বাউলেরা নাথ, বৈষ্ণব ও সুফি মতবাদের মিশ্রণে সাধনায় নিবিষ্ঠ থাকেন, অন্যদিকে তারা জিন্দাদেহে মুর্দার বেশ তথা সাদা কাপড় পরিধান করেন, আর মুখে বলেন ‘আলেক সাঁই’, ‘আল্লাহ আলেক’, ‘জয় গুরু’, ‘সাঁই নিরঞ্জন’ ইত্যাদি, এদের সাধন-করণ হিসেবে সাধুসঙ্গ করতে দেখা যায়, সে সাধুসঙ্গের সাথে দিনডাকা, আসন দেওয়া, সেবাগ্রহণ, গান গাওয়া ইত্যাদি স্বতন্ত্র্য কিছু নিয়ম মেনে সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউলেরাও ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়েই তাদের সাধন-ভজন করেন। তবে, এ সকল অঞ্চলের বাউলদের সঙ্গে সুফিদের নিকট সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে, করণ-কার্যের অনেক কিছুতেই তারাও সুফিদের থেকে স্বতন্ত্র্য পরিচয়ের অধিকারী।

বাউল-সাধক ও পদকর্তা : বাংলার বাউল-সাধক পদকর্তাদের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের দাবীদার হলেন- ফকির লালন সাঁই। তিনি আনুমানিক ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধরাধামে ছিলেন। লালন সাঁই তাঁর সমগ্রজীবন ব্যয় করেছেন বাউল-সাধনার স্থায়ী ও একটি গানগত রূপ দিতে, তাঁর গানে বাউল-সাধনার করণ-কার্যের নানাবিধ নির্দেশনা আছে। তিনি দৈন হতে শুরু করে গোষ্ঠ, গৌর, আত্মতত্ত্ব, আদমতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ইত্যাদি পর্বের গানের পাশাপাশি সমাজ-সংস্কারমূলক মানবিকতার উদ্বোধনমূলক গান রচনা করেছেন। বাউল-সাধনার গুরু-শিষ্য পরম্পরার লালন প্রবর্তিত ধারাটি অদ্যাবধি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত বেগবান রয়েছে। লালনপন্থী সাধকদের মধ্যে পদ রচনায় অন্যান্য যারা শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেছেন, তারা হলেন- দুদ্দু শাহ, খোদাবক্শ শাহ, বেহাল শাহ, মকছেদ আলী সাঁই, মহিন শাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ও ভারতের বাউল-সাধক, পদকর্তা ও সংগীতশিল্পী হিসেবে যাদের স্বীকৃতি রয়েছে, তাঁরা হলেন যাদু বিন্দু, দ্বিজ দাস, পাঞ্জু শাহ, গোসাই গোপাল, হাছন রাজা, নবনী দাস বাউল, পূর্ণদাস বাউল, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ। বাউল-সাধনা ও বাউল গান রচনার ধারা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও প্রবহমান ও সজীব একটি ধারা, যুগে যুগে কালে কালে শত সহ¯্র বাউলেরা পূর্বে যেমন এই সাধনা ও গানের ধারা চর্চা করেছেন, বর্তমান কালেও অসণিত বাউল-সাধক-ভক্তগণ এই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গেলে এখনও তাই বাউলের দেখা মেলে, এমনকি চলতে পথে রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে বা শহরাঞ্চলেও বাউলশিল্পীদের প্রসার চোখ এড়িয়ে যায় না, কেননা তাদের কণ্ঠে থাকে সুমধুর গান আর ভাবের বিস্তার।   

  

 

তথ্যনির্দেশ

১. আহমদ শরীফ, বাউলতত্ত্ব, ঢাকা : পড়–য়া, ২০১৩, পৃ. ৪২

২. মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রথম খ-, “বঙ্গে সূফি প্রভাব”, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯১, পৃ. ১৬০

৩. প্রাগুক্ত

৪. গ্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯

৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯-৬০

৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬০

৭. চুয়াডাঙ্গা জেলার লালনপন্থী সাধক-শিল্পী আব্দুল লতিফ শাহের কাছ থেকে সংগৃহীত

৮. শক্তিনাথ ঝা, বস্তুবাদী বাউল, কলিকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০১০, পৃ. ৮৫

৯. ফকির আনোয়ার হোসেন (মন্টু শাহ), লালন-সঙ্গীত, প্রথম খ-, কুষ্টিয়া : ছেঁউড়িয়া, ২০১১, পৃ. ৮৬

১০. শক্তিনাথ ঝা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫-১৪৬ দ্রষ্টব্য

১১. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬

১২. মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৮

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

আহমদ শরীফ, বাউলতত্ত্ব, ঢাকা : পড়–য়া, ২০১৩

উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাংলার বাউল ও বাউল গান, কলকাতা, নববর্ষ ১৩৭৮

মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রথম খ-, “বঙ্গে সূফি প্রভাব”, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯১

মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, হারামণি, দ্বিতীয়খ-, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২

শক্তিনাথ ঝা, বস্তুবাদী বাউল, কলিকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০১০

সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, কলিকাতা : পুস্তক বিপণি, ২০০৭

বাউল

সাইমন জাকারিয়া

 

ভূমিকা : বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ সৃজনশীল সাধকদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই সম্প্রদায় মূলত দেহ-সাধনা করেন এবং গানের মাধ্যমেই সেই দেহ-সাধনার কথা প্রকাশ ও প্রচার করেন। বাউলদের রচিত গানের ভাবের গভীরতা, সুরের মাধুর্য, বাণীর সার্বজনীন মানবিক আবেদন বিশ্ববাসীকে মহামিলনের মন্ত্রে আহ্বান করে। তাই ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বাংলার বাউলগানকে দি রিপ্রেজেন্টিটিভ অব দি ইন্টানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির তালিকাভুক্ত করে। অবশ্য তার আগেই বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশক হতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউলগান ও বাউলদের সাধনপদ্ধতি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। পাশাপাশি বাংলার বাউলগান পরিবেশন করতে গ্রামের বাউল সাধকশিল্পীগণ নানা দেশ ভ্রমণ করেন। তবে, জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পরিমহলে বাউলদের সাধনা ও গান সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবীর তৎপরতায়, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার বাউল ও বাউল সম্পর্কে বিশেষভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এমনকি নিজের রচনার ভাবসম্পদ হিসেবে বাউলগানের ভাবাদর্শ তিনি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর গৃহীত হয়েছিল বাউল গগন হরকার গান হতে। 

 

বাউল সাধনার ইতিহাস ও সাধন-পদ্ধতি : দেহকেন্দ্রিক বাউল-সাধনার সাথে প্রাচীন ভারতীয় সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রের সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে, বাউল-সাধনা মূলত বৈদিক বা ব্রাহ্মণ আচার বিরোধী এবং মৈথুনাত্মক ও রাগানুগা সাধনার পক্ষপাতী। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া ও নাথধর্মের দেহ-সাধনার সাথে বাউল-সাধনার নৈকট্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাহিত্য-সংস্কৃতির নিদর্শন আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত চর্যাগীতির অনেক পদের সাথে বাংলার বাউলদের দেহ-সাধনার প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়। যেমন- চর্যার প্রথম পদেই লুইপা যে দেহ সাধনার কথা বলেছেন, তা হলো- ‘কাআ তরু বর পঞ্চ বি ডাল।/চঞ্চল চিএ পৈঠ কাল॥/দৃঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।/লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জান॥’ অর্থাৎ মানবদেহে বৃক্ষশাখার মতো পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, আর তাদের চব্জলতার জন্য মৃত্যু ধেয়ে আসে। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মহাসুখের দেখা মেলে। লুই বলেন- গুরুর কাছ থেকেই কেবল সেই দেহ-সাধনায় মহাসুখ পাবার কৌশল জানা যায়। এ ধরনের কথার ভেতর দিয়ে দেহ-সাধনার জন্য যে গুরু আবশ্যক সেই নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলার বাউলরা আজও দেহ-সাধনার জন্য চর্যায় বর্ণিত সেই গুরুকেই আশ্রয় করে থাকেন। কিন্তু বাউল-সাধনার পূর্ণাঙ্গ উদ্ভব ও বিকাশ কাল হিসেবে সাধারণত ১৪৮৬ হতে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান চৈতন্যদেবের সময়কে শনাক্ত করা হয়। কথিত আছে যে, চৈতন্যদেবের মৈথুনাত্মক সাধন-পদ্ধতি অনুসরণে আউল চাঁদের শিষ্য মাধববিধি বাউলমত প্রবর্তন করেন এবং মাধববিবির শিষ্য বীরভদ্রের তৎপরতায় এই মতের বিস্তৃতি ঘটে। বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ডক্টর আহমদ শরীফ বলেন, “যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল আর যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দু-সমাজ ভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মাচরণে রত ছিল, তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উল্টরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।”১ 

বাউল সাধনার সাথে যেহেতু নানা ধর্মমতের প্রভাব রয়েছে সেহেতু বাউল গানে হিন্দু প্রভাবে রাধা-কৃষ্ণ, শিব-শিবানী, মায়া-ব্রহ্ম, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি পুরুষ-প্রকৃতির প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, মুসলিম প্রভাবে তেমনি মোকাম, মঞ্জিল, লতিফা, সিরাজম্মুনিরা, আল্লাহ, কাদের, গনি, রসুল, রুহ, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহম্মদ-খাদিজা, আলি-ফাতেমা প্রভৃতি প্রতীকী রূপক গৃহীত হয়েছে। আবার বৌদ্ধ নাথ এবং নিরঞ্জনও পরিত্যক্ত হয়নি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৌরাণিক উপমা ও কুরআন-হাদিসের বাণীর নানা ইঙ্গিত [যেমন বর্জখ]। অবশ্য বাউল রচনায় এসব শব্দ ও পরিভাষা তাদের মতানুগ অর্থান্তর তথা নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। বৈষ্ণব ও সূফী সাধনার সঙ্গে বাউল মতের মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি পরিহার করে যে মিলন-ময়দান তারা তৈরি করল, তাকে সার্থক ও স্থায়ী করার জন্য পরমাত্মা বা উপাস্যের নামেও এক সর্বজনীন পরিভাষা তারা সৃষ্টি করেছে। তাদের ভাষায় ‘পরমতত্ত্ব’ পরমেশ্বর বা সচ্চিদানন্দ হচ্ছেন মানুষ, অটল মানুষ, সহজ মানুষ, অধর মানুষ, রসের মানুষ, ভাবের মানুষ, অলখ সাঁই, অচিন পাখি, মনুরা প্রভৃতি পরমাত্মা- আত্মারই পূর্ণাঙ্গ রূপ। বাউল মতে, দেহস্থিত আত্মাকে কিংবা আত্মা সম্বলিত নরদেহকে যখন ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করা হয়, তখন পূর্ণাঙ্গ বা অখ- আত্মা বা পরমাত্মাকে মানুষ বলতে বাধা থাকে না।  

বাউল সাধনার এই প্রকৃতি বিচারে ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় সতেরো শতকের মধ্যভাগ হতে বাউল মতের উদ্ভব। গুরু, মৈথুন ও যোগ তিনটিই সমগুরুত্ব পেয়েছে বাউল মতে। তাই গুরু, বিন্দুধারণ ও দম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা বাউল গানে অত্যাধিক। সৎগুরুর কাছে দীক্ষা না নিলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা অসম্ভব এবং বিন্দুধারণে সামর্থ্যই সিদ্ধির প্রকৃষ্ট নিদর্শন। বাউল মতে আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। এই দেহস্থিত আত্মাই মানুষ, মানের মানুষ, রসের মানুষ, অলখ সাঁই। বাউলের ‘রসস্বরূপ’ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দস্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস। এটিই আত্মতত্ত্ব। এর মাধ্যমে অরূপের কামনায় রূপ সাগরে ডুব দেয়া, স্বভাব থেকে ভাবে উত্তরণ। সহজিয়াদের ‘সহজ’ই সহজ মানুষ। মৈথুন মাধ্যমে বিন্দুধারণ ও উর্ধ্বে সঞ্চালনের সময়ে গঙ্গা (ইড়া) ও যমুনা (পিঙ্গলা) বেয়ে সরস্বতীতে (সুষু¤œায়) ত্রিবেণঅ (মিলন) ঘটাতে হয়। তারপর সেখান থেকে সহ¯্রায় (মস্তকস্থিত-সহ¯্রদল পদ্মে) যখন বিন্দু গিয়ে পড়ে, তখনই সৃষ্টি হয় মহাভাব বা সহজ অবস্থা। বাউলগণ মূলত সাধনায় সেই মহাভাব অর্জন করেন।

বাউলের শাব্দিক অর্থ ভেদ: বাংলার বাউল, বাউল মত ও বাউল সংগীত তথা বাউল গান নিয়ে নানা জনের নানা মত প্রচলিত। এই মতানৈক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে “বাউল” শব্দটি। আসলে, “বাউল” শব্দটির অর্থ, তাৎপর্য, উৎপত্তি ইত্যাদি নিয়ে অদ্যাবধি গবেষকেরা যেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি, তেমনি “বাউল মত”-এর স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রদান করতে পারেন নি। নানা জনের নানা মত নিয়েই “বাউল মত” বিষয়ে অমীমাসিংত আলোচনা চলছে এবং চলমান থাকবে বলেই আমাদের ধারণা।

বাউল মত ও তার উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কোনো কোনো গবেষক বলেছেন- সংস্কৃত “বায়ু” থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, তাঁদের মতে সংস্কৃত বায়ু= বাঙ্গালা “বাই”, “বাউ” শব্দের সাথে স্বার্থে “ল” প্রত্যয়যোগে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, এই মতানুসারি গবেষকদের ভাষ্যে জানা যায়- বাংলার যে সব লোক “বায়ু” অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সাহায্যে সাধনার মাধ্যমে আত্মিক শক্তি লাভ করার চেষ্টা করেন, তাঁরাই বাউল।২

গবেষকদের কেউ কেউ আবার বলেছেন- সংস্কৃত “বাতুল” শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, প্রাকৃত ব্যাকরণ মতে- দুই স্বরবর্ণের (এখানে “আ” এবং “উ”) মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ (এখানে “ত”) লোপ পায়, আসলে এঁই সূত্রমতেই “বাতুল” শব্দটি “বাউল” হয়ে গেছে, গবেষকদের মতে- যে সব লোক প্রকৃতই পাগল, তাই তাঁরা কোনো সামাজিক বা ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ মানে না, তাঁরাই বাউল।৩ 

বাউল মতের স্বরূপ নির্ধারণের প্রশ্নে গবেষকদের অন্য দল বলেন- প্রাকৃত “বাউর” শব্দ হতে “বাউল” শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে, “বাউর” অর্থ এলো-মেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল। এই দলের গবেষক-মতে, বাংলার বাউলদের মতো একদল বিশৃঙ্খল চিন্তাজীবী লোক উত্তর-ভারতে প্রত্যক্ষ করা যায়, বাংলার বাউল চিন্তার দিক হতে তাদেরই এক গোষ্ঠীভুক্ত। সুতরাং উত্তর-ভারতীয় প্রাকৃত শব্দ “বাউর” বাংলাদেশে “বাউল” শব্দে পরিণত হয়ে থাকবে, কেননা লোকায়ত সমাজে উচ্চারণ-ধ্বনির দিক দিয়ে “র” এবং “ল” বর্ণের সাদৃশ্য থাকায় অনেক ক্ষেত্রে এই দুটি বর্ণ পরস্পরের রূপ গ্রহণ করে থাকে।

আরেক শ্রেণীর গবেষকদের ভাষ্যমতে- “বাউল” শব্দকে “আউল” শব্দের পৌনঃপুনিক অপভ্রংশ বলে মনে করেন, তবে তাঁরা এ কথা মনে করেন না যে “আউল” শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত “আকুল” শব্দ হতে, তার বদলে মুসলমান সাধক অর্থে আরবি “অলী” শব্দের বহুবচন “আউলিয়া” শব্দ হতে “ইয়া” প্রত্যয়ের পতনে উৎপত্তি বলে মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে- বাংলার যে সব লোক মুসলমান দরবেশদের মতো লম্বা আল্খেল্লা পরে, তাঁদের বাণী ও বিশ্বাসে আস্থাপরায়ণ হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাঁরাই বাউল। এই জন্যই নাকি বাউল-সন্ন্যাসীদের “ফকির” বলা হয়।৫ 

গবেষক মুহম্মদ এনামুল হক “বাউল” শব্দের উৎপত্তি ও তার অর্থ সম্পর্কে উপর্যুক্ত নিষ্পত্তিগুলো উদ্ধৃতি দিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, “বাউল সম্প্রদায়ের নাম বাউলেরা নিজে গ্রহণ করে নাই। সাধারণ বাউল-বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করিয়াই, দেশের লোক তাহাদিগকে এই নাম দিয়াছে।”৬

মুহম্মদ এনামুল হকের এই বক্তব্যের সাথে একথা যুক্ত করা অসঙ্গত হবে না যে, বাউলেরা নিজেরা যেহেতু নিজেদের বাউল নামটি দেন নি সেহেতু “বাউল” শব্দটির উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত রয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বাউল মতের মর্মকথা অনুধাবন করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। 

বাউল গানে বাউলের সংজ্ঞা : বাউলের প্রকৃতি সম্পর্কে বাউল গানে নানা ধরনের তথ্য বিবৃত হয়েছে। এ পর্যায়ে বাউল-সাধকের রচিত সংগীতের বাণীকে আশ্রয় করেই বাউল মতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেমন, একটি বাউল সংগীতের বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে-     

 

যে খুঁজে মানুষে খুদা 

সেই তো বাউল

বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে 

পাই তার উল॥

 

পূর্ব জন্ম না মানে 

ধরা দেয় না অনুমানে

মানুষ ভজে বর্তমানে 

হয় রে কবুল॥

 

বেদ তুলসী মালা টেপা

এসব তারা বলে ধুকা

শয়তানে দিয়ে ধাপ্পা 

করে ভুল॥

 

মানুষে সকল মেলে

দেখে শুনে বাউল বলে

দীন দুদ্দু কি বলে

লালন সাঁইজির কুল॥৭

বাংলাদেশের ঝিনাইদহ অঞ্চলের বাউল-সাধক দুদ্দু শাহ কর্তৃক উপর্যুক্ত সংগীতের বাণীতে “বাউল মত” তথা বাউলতত্ত্বের মূল-কথাটা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কেননা, বাংলার বাউলদের মূল পরিচয়ের প্রধানতম একটি দিক হলো- তাঁরা মানুষেই শ্রষ্টার সন্ধান করেন। দ্বিতীয়ত দিক হলো- তাঁরা প্রচলিত ধর্মগোষ্ঠীর লোকদের মতো অনুমানে বিশ্বাস করেন না, এমনকি পূর্বজন্ম বা জন্মান্তরবাদকে মানতে নারাজ; তৃতীয়ত- বেদ তুলসী মালা টেপাকে তাঁরা ধোক্কার কাজ বলে গণ্য করেন। আসলে, প্রচলিত ধর্মীয় চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলার বাউল মত মূলত ‘মানুষে সকল মেলে’ এই তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।

বাউল-গবেষক শক্তিনাথ ঝা তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন- ‘বাউল মতবাদ কোন ধর্ম নয়। সম্প্রদায় কথাটি শিথিলভাবে এখানে ব্যবহৃত হতে পারে। বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠী ও সামাজিক স্তরের ব্যক্তি বিশেষ গুরুর কাছ থেকে এ মতবাদ, গান ও সাধনা গ্রহণ করে নিজ নিজ সামর্থ্য ও সংস্কারানুযায়ী তা পালন করতে চেষ্টা করে এবং এক শিথিল স্বেচ্ছামূলক ম-লী গঠন করে। সাধক আবার গুরু হিসাবে বিশ্লিষ্ট হয়ে পৃথক এক বৃত্ত নির্মাণ করে। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য ও বৈচিত্র্য দুই-ই আছে। বাউল তত্ত্বে এবং সাধনায় প্রচলিত মূল্যবোধ ও আচারকে বিপরীত রূপে আদর্শায়িত করা হয়, প্রচলিত শাস্ত্রবিরোধী সাধনা নানা বৈচিত্র্য-মত রূপে বাউল জীবনচর্যা রচনা করেছে। অলৌকিক ঈশ্বর, দেহব্যতিরিক্ত আত্মা, স্বর্গাদি পরলোকে অবিশ্বাসী বাউল ইহবাদী, দেহবাদী। আর্থ- সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিধিবিধানের প্রতিবাদী মানুষেরা বাউল মতবাদ গ্রহণ করে।’৮ 

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বাউল মতের প্রভাব রয়েছে। তবে, এক এক অঞ্চলের বাউল মত এক এক রকমভাবে বিকাশ লাভ করেছে। যেমন- কুষ্টিয়া অঞ্চলের লালনপন্থী বাউল-সাধকদের সাধনা-পদ্ধতি, জীবনাচার-বেশ-বাস, সাধুসঙ্গ, এমনকি গায়কী ও গানের সুর-বাণী ইত্যাদির সাথে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ইত্যাদি অঞ্চলের বাউলদের তেমন কোনো সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু ভাবের দিক দিয়ে ও সাধনার ঘর হিসেবে দেহকে আশ্রয় করার বিষয়ে কিছুটা মিল রয়েছে। আসলে, সব অঞ্চলের বাউলেরাই সাধনার আশ্রয় হিসেবে দেহকে অবলম্বন করে থাকেন এবং দেহ-ঘরের মধ্যে তাঁরা সৃষ্টি-শ্রষ্টার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন, আর গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রায় সব অঞ্চলের বাউলেরা সাধনার ধারা অব্যাহত রাখেন। এক্ষেত্রে গুরুকে তাঁরা শ্রষ্টার সমতুল্য বিবেচনা করেন। তাঁরা মনে করেন গুরু বা মুর্শিদকে ভজনা করার ভেতর দিয়ে শ্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করা যায়। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরাভেদকে লালন সাঁইজি প্রকাশ করেছেন এভাবে- 

যেহি মুর্শিদ সেই তো রাছুল

ইহাতে নেই কোন ভুল

খোদাও সে হয়;

লালন কয় না এমন কথা

কোরানে কয়॥৯

বাংলাদেশের বাউলেরা এভাবেই অকাট্য যুক্তির আলোকে শরিয়তি গ্রন্থকে সামনে রেখেই গুরুবাদী ধারার সাধনচর্চাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ-গুরু ভজনা এবং মানুষকে সেজদার যোগ্য বিবেচনা করে, তার ভেতর দিয়েই যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট ইবাদত সম্ভব বাংলার বাউল-সাধকেরা সেকথা ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করেন নি।

এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলার বাউল মত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। তাই বাউলেরা বৈষ্ণব, চিশতিয়া প্রভৃতি সাধক-শ্রেণীর মতো কোনো বিশিষ্ট সম্প্রদায় নয়। বৈষ্ণব ও বিভিন্ন শ্রেণীর সুফি মতের অনুসারীরা যেমন তাঁদের প্রতিষ্ঠাতার নাম বলতে পারেন, বাউলেরা তা পারেন না। অতএব, আদি বাউল কে- তা নিয়ে বির্তকের কোনো শেষ নেই।

বাউল-গবেষক শক্তিনাথ ঝা অবশ্য বিভিন্ন গবেষকের সূত্র মিলিয়ে বাংলার বাউল মতের প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত দিয়েছেন চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি সাহিত্য নিদর্শনের উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা সহকারে।১০ তাঁর মতে, বাউলদের আদিগুরুর নাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না গেলেও এ কথা অন্তত বলা যায়- বাংলার ‘বাউল পন্থা কোন অর্বাচীন মতবাদ নয়।’১১ 

বাউলদের স্বরূপ ও পরিচয় দিতে গিয়ে মুহম্মদ এনামুল হক বলেন “বাউল”-দিগকে “বাতুল” অর্থাৎ পাগল বলা হয়। বাউলেরা যাঁহার সন্ধানে পাগল, তাঁহার কোন নাম নাই,- তিনি “অনামক”। তবে তাঁহারা তাঁহাকে যখন যাহা খুশী সেই নামে অভিহিত করে। তাই দেখিতে পাই, তাহারা তাঁহাকে “মন-মনুরা”, “আলেক্”, “আলেখ্ সাঁই”, “অচিন পাখী”, “মনের মানুষ”, “দরদী সাঁই” ও “সাঁই” প্রভৃতি কত নামেই না পরিচিত করিতে চেষ্টা করিয়াছে। এইরূপ যে নামেই তাহারা তাঁহাকে পরিচয় দিক না কেন, তিনি তাহাদের নিকট চিরদিনই “অনামক”। হিন্দুর “ব্রহ্ম”, বৈষ্ণবের “কৃষ্ণ”, বা মুসলমানের “আল্লাহ”-এর ন্যায় কোন একটি বিশিষ্ট নাম আরোপ করা তাহাদের স্বভাব নয়।”১২ একই সঙ্গে সেই পরমসত্তাকে বাংলার বাউলেরা সাধারণ ধর্মাচারী মানুষের মতো তারা ভীতিকর এবং দেহ ও নিজের আত্মগত সত্তার বাইরের বস্তু বলেও মনে করে না। বরং দেহকেন্দ্রিক ষট্চক্র যোগে সাধনায় আত্ম তথা স্রষ্টা দর্শনের অপূর্ব প্রশান্তি খুঁজে ফেরেন। 

বাউলের আঞ্চলিক বৃত্ত : বাংলার বাউলদের আঞ্চলিক সীমারেখা হল বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অব্জল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশপরগণা ইত্যাদি। এই যে বিশাল এলাকা জুড়ে বাউলদের বিস্তার ঘটেছে, তাতে সবখানে একই ধরনের বাউল প্রত্যক্ষ করা যায় না। আসলে, অঞ্চলভেদে বাউলদের বেশ-বাস হতে শুরু করে গানের কথায়, সুরে, এমনকি সাধন-পদ্ধতিতে, করণ-কার্যে নানা ধরনের বৈসাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন রাঢ় অঞ্চলের বাউলদের সাথে মধ্যবঙ্গের বাউলদের অন্তর্গত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। আসলে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া-মুর্শিদাবাদ বা বীরভূম-বাকুড়া অঞ্চলের বাউলেরা বৈষ্ণবপ্রভাবিত, তারা বৈষ্ণবদের মতো যেমন গেরুয়া-হলুদ পোশাক পরিধান করেন, তেমনি গানের শুরুতে বা পরে মুখে বলেন ‘হরি হরি’ বা ‘হরি বোল’; পক্ষান্তরে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ফরিদপুর, মাগুরা অঞ্চলের বাউলেরা নাথ, বৈষ্ণব ও সুফি মতবাদের মিশ্রণে সাধনায় নিবিষ্ঠ থাকেন, অন্যদিকে তারা জিন্দাদেহে মুর্দার বেশ তথা সাদা কাপড় পরিধান করেন, আর মুখে বলেন ‘আলেক সাঁই’, ‘আল্লাহ আলেক’, ‘জয় গুরু’, ‘সাঁই নিরঞ্জন’ ইত্যাদি, এদের সাধন-করণ হিসেবে সাধুসঙ্গ করতে দেখা যায়, সে সাধুসঙ্গের সাথে দিনডাকা, আসন দেওয়া, সেবাগ্রহণ, গান গাওয়া ইত্যাদি স্বতন্ত্র্য কিছু নিয়ম মেনে সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউলেরাও ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়েই তাদের সাধন-ভজন করেন। তবে, এ সকল অঞ্চলের বাউলদের সঙ্গে সুফিদের নিকট সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে, করণ-কার্যের অনেক কিছুতেই তারাও সুফিদের থেকে স্বতন্ত্র্য পরিচয়ের অধিকারী।

বাউল-সাধক ও পদকর্তা : বাংলার বাউল-সাধক পদকর্তাদের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের দাবীদার হলেন- ফকির লালন সাঁই। তিনি আনুমানিক ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধরাধামে ছিলেন। লালন সাঁই তাঁর সমগ্রজীবন ব্যয় করেছেন বাউল-সাধনার স্থায়ী ও একটি গানগত রূপ দিতে, তাঁর গানে বাউল-সাধনার করণ-কার্যের নানাবিধ নির্দেশনা আছে। তিনি দৈন হতে শুরু করে গোষ্ঠ, গৌর, আত্মতত্ত্ব, আদমতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ইত্যাদি পর্বের গানের পাশাপাশি সমাজ-সংস্কারমূলক মানবিকতার উদ্বোধনমূলক গান রচনা করেছেন। বাউল-সাধনার গুরু-শিষ্য পরম্পরার লালন প্রবর্তিত ধারাটি অদ্যাবধি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত বেগবান রয়েছে। লালনপন্থী সাধকদের মধ্যে পদ রচনায় অন্যান্য যারা শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেছেন, তারা হলেন- দুদ্দু শাহ, খোদাবক্শ শাহ, বেহাল শাহ, মকছেদ আলী সাঁই, মহিন শাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ও ভারতের বাউল-সাধক, পদকর্তা ও সংগীতশিল্পী হিসেবে যাদের স্বীকৃতি রয়েছে, তাঁরা হলেন যাদু বিন্দু, দ্বিজ দাস, পাঞ্জু শাহ, গোসাই গোপাল, হাছন রাজা, নবনী দাস বাউল, পূর্ণদাস বাউল, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ। বাউল-সাধনা ও বাউল গান রচনার ধারা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও প্রবহমান ও সজীব একটি ধারা, যুগে যুগে কালে কালে শত সহ¯্র বাউলেরা পূর্বে যেমন এই সাধনা ও গানের ধারা চর্চা করেছেন, বর্তমান কালেও অসণিত বাউল-সাধক-ভক্তগণ এই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গেলে এখনও তাই বাউলের দেখা মেলে, এমনকি চলতে পথে রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে বা শহরাঞ্চলেও বাউলশিল্পীদের প্রসার চোখ এড়িয়ে যায় না, কেননা তাদের কণ্ঠে থাকে সুমধুর গান আর ভাবের বিস্তার।   

  

 

তথ্যনির্দেশ

১. আহমদ শরীফ, বাউলতত্ত্ব, ঢাকা : পড়–য়া, ২০১৩, পৃ. ৪২

২. মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রথম খ-, “বঙ্গে সূফি প্রভাব”, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯১, পৃ. ১৬০

৩. প্রাগুক্ত

৪. গ্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯

৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯-৬০

৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬০

৭. চুয়াডাঙ্গা জেলার লালনপন্থী সাধক-শিল্পী আব্দুল লতিফ শাহের কাছ থেকে সংগৃহীত

৮. শক্তিনাথ ঝা, বস্তুবাদী বাউল, কলিকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০১০, পৃ. ৮৫

৯. ফকির আনোয়ার হোসেন (মন্টু শাহ), লালন-সঙ্গীত, প্রথম খ-, কুষ্টিয়া : ছেঁউড়িয়া, ২০১১, পৃ. ৮৬

১০. শক্তিনাথ ঝা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫-১৪৬ দ্রষ্টব্য

১১. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬

১২. মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৮

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

আহমদ শরীফ, বাউলতত্ত্ব, ঢাকা : পড়–য়া, ২০১৩

উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাংলার বাউল ও বাউল গান, কলকাতা, নববর্ষ ১৩৭৮

মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রথম খ-, “বঙ্গে সূফি প্রভাব”, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯১

মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, হারামণি, দ্বিতীয়খ-, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২

শক্তিনাথ ঝা, বস্তুবাদী বাউল, কলিকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০১০

সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, কলিকাতা : পুস্তক বিপণি, ২০০৭