রুপান্তরের রহস্যঃ অপু ও সিদ্ধার্থ/ Apu and Siddharth: Mystery of Transformation

in Article
Published on: 06 September 2018

Sanjoy Mukhopadhyay

Professor, Department of Film Studies, Jadavpur University

          

পঞ্চাশ বছর আগের একদিনে শ্রী অপূর্বকুমার রায়, অপু, তাঁর সদ্য পরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।কি অসামান্য সেই ডিজিলভঃ পৌরানিক ছবির বিস্ময় থেকে এক্কাগাড়ির দাম্পত্য! বাস্তবিক,সত্যজিত রায়ের ও সেই সূত্রে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের আধুনিকতার ধারণা বিষয়ে মন্তব্য হিসেবেই পড়া যেতে পারে।আসলে অপুর ইতিবৃত্ত তো সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রগতি বা আলোকপ্রাপ্তি ও বিকাশ সম্পর্কে যা ভেবেছে, তারই একটি জৈব রুপকথা।

 

মার্কস যে বর্ণাশ্রম-ভিত্তিক বদ্ধ ভারতীয় পল্লিসমাজের কথা খেয়াল করেছিলেন,তার একটি থেকে হরিহর ও তার পরিবার বেরিয়ে আসে। তাদের গন্তব্য একমুখী; কোনওদিন সত্যজিৎ রায় তাদের আর জিন্মভিটেয় ফেরাবেন না। দেশ বলতে একটি ভৌগলিক মানচিত্র জন্ম নিল ঔপনিবেশিক শিক্ষার বদান্যতায়। সূর্যঘড়ি অপুকে ‘সময়’ চেনায়; হেডমাস্টারমশাই তাকে লিভিং স্টোনের ভ্রমনবৃত্তান্ত পড়তে দিলে সে ‘অজানা’কে আবিষ্কার করে। তার পরেই শিয়ালদহ স্টেশনে তার ঐতিহাসিক অবতরণ। অপু হ্যারিসিন রোডে দাঁড়িয়ে থাকলেও এই ‘হ্যারিসিন রোডে তবু গভীর অসুখ’ বোধ করে না, বরং সে ছাপাখানায় এসে পৌঁছলে আমাদের মনে করার সঙ্গত কারণ থাকে যে এই সেই ‘গুটেনবার্গ ছায়াপথ’, যে পথ ধরে শুধু ধর্মশাস্ত্র গির্জার থেকে বেরিয়ে আসবে না, জ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণও সম্ভব হবে। মনে পড়ে, প্রেসের এজমালি ঘর থেকে মা’কে লেখা তার চিঠির শেষ লাইন- আমার ঘরে একটি বিজলি বাতি আছে। অপরাজিত মুক্তি পায় ১৯৫৬-য়, আর মাত্র আট বছর বাদে মিডিয়াবিদ মর্শাল ম্যাকলুহান টরেন্টো থেকে জানাবেন বিজলি বাতি একটি তথ্য।

 

 অপুর সংসারের যুগের স্বপ্নের কথা সম্প্রতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন।সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ত্রয়ী’ আধুনিকতার একটি চলমান স্বপ্নমালা, তাদের স্রষ্টা বঙ্গীয় মতাদর্শের অন্যতম প্রবক্তা।

 

 অপুকে কে আলাদা করে দিল সর্বজয়ার থেকে? এই দায় একমাত্র কলকাতা শহরের; লীলা বা অন্য কোনো আকর্ষণের প্রশ্নই অবান্তর। পুরোহিতপুত্র হয়েও সে বংশানুক্রমিক পেশায় থাকতে চাইল না, মলিন ঘর থেকেই বাঁশিতে সুদূরকে ডাক দেয়, মা’র শেষকৃত্যের জন্যও গ্রামে থাকতে নারাজ- বোঝাই যায়, সভ্যতার রুপান্তর বিষয়ে কিছু প্রাথমিক তথ্যের অবতারণা করা হল। ‘যা কিছু কঠিন তা বাতাসে গলে যায়, যা কিছু অলৌকিক তা হয়ে যায় ঐহিক’ – অপরাজিততে অপূর্বর মূল্যবোধ যে ভাবে বদলে যায়, তাতে তো সময় সময় সাম্যবাদী ইস্তেহারের ‘বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত’ অংশের অসামান্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ মনে পড়ে। কেউ কি ভেবেছিল কাশবনের অদূরে একটি রেলগাড়ি গ্রাম্য বালকটিকে টেনে নিয়ে যাবে শহরে, ইতিহাসে!পথের পাঁচালীর গ্রামচ্যুতি থেকে অপুর সংসারের দাম্পত্য নির্মাণ সত্যজিৎ রায়ের প্রগতি সম্পর্কিত ধারণার থেকেই উদগত। এই প্রগতি রৈখিক ও একমুখী; তার গতি শুধু সামনের দিকেই। তাতে ক্ষণতরেও পশ্চাদ্ভ্রমন নেই, নেই কোনও আকস্মিক বাঁক। অর্থাৎ সংশয় নেই। তাঁর উনিশ শতকীয় পূর্বশূরিদের ধরনেই সত্যজিৎ ইউরোপীয় যুক্তিবাদের মূল সূত্রগুলিকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছেন। যে মানবতাবাদ রনেসাঁ থেকে দেকার্তের হাত ধরে বিশ্বাস করে মানুষ শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক ও প্রণালিবদ্ধ যুক্তির প্রভাবেই ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারে, গ্লোব-হাতে অপু সেই মতবাদের শরিক। তবু সত্তর দশক শুরু হতেই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তে যে যুবাচতুষ্টয় বা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র সিদ্ধার্থ চৌধুরি অপুর সংসারে প্রবেশের মাত্র বারো বছরের মধ্যে রুঢ় ভাবে পালটে গেল।অপূর্ব যখন অপর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকত, তখন একটি কথার দ্বিধাথরথরচূড়ে ভর করত গীতিকবিতা। সিদ্ধার্থ খররৌদ্রে যখন জেব্রা ক্রসিং পার হতে থাকা তরুণীর বক্ষদেশের দিকে তাকায়, তখন নয়নে মদিরেক্ষণ মায়া নেই, রহস্য মোচন করে মেডিক্যাল কলেজের লেকচার থিয়েটার। এখানে পঞ্চাশ দশকের কুসুমের মাস নয়, সত্তর দশকের আমিষ গন্ধ।

 

নেহেরু যুগের অর্থনীতি, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নাগরিকের ভূমিকা, পরিকল্পনার আশ্বাস সিদ্ধার্থকে উন্নয়নের মৌতাতে মজিয়ে দিতে পারে না। মধ্যবয়সী ঈষৎ লাজুক কন্ডোম ক্রেতাকে সে খেয়াল করে তাচ্ছিল্য ভরে। ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্রে সহাস্য ইন্দিরা গান্ধীকে দেখে সে চোখ বোজে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কৌটো ভেঙে পয়সা বার করে নেওয়া বা যুবতী নার্সের বক্ষবন্ধনী ও ফিল্ম সোসাইটির ‘আর্ট’ তার কাছে নৈতিকতার দহন বা সাংস্কৃতিক প্ররোচনা নয়, উদ্দেশ্যহীনতার ক্লান্তি অথবা উপায়হীন উদাসীনতা। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে সত্যজিৎকে বেশ তিক্ত ও বিচলিত লাগে। এই বিরক্তি ও আত্মগ্লানি তাঁকে, এমনকী ‘সীমাবদ্ধ’ বা ‘জন-অরণ্য’তেও সঙ্গ দিয়ে যাবে। সত্তর দশকের অপুকে তো আর শাপভ্রষ্ট দেবশিশুর মতো মনে হয় না। স্বপ্নবিপর্যয়ের এই ইতিবৃত্ত তা হলে কী ভাবে পড়া হবে?এই ধাঁধার জবাব এত সরল নয় যে বিভূতিভূষণ থেকে সুনীল পর্যন্ত উপন্যাসের ঋতুবদল খেয়াল করলেই হদিস মিলবে; সত্যজিৎ তো অনুবাদক মাত্র নন।

 

 রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আমরা সান্ত্বনা খুঁজতাম বিজ্ঞান সমর্থিত যুক্তিবাদে।বিশ্ববিদ্যালয়,ধর্মাধিকরণ ও সচিবালয় যে বানী প্রচার করত, তা মূলত পাশ্চাত্য দীপায়ণের পাঠক্রম। আটষট্টি সাল নাগাদ কতিপয় ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর দখল করলে পশ্চিমীরা বুঝতে পারে পাঠাভ্যাস বদলাতে হবে; দেখারও রকমফের আছে। তুলনা টানছি না, কিন্তু ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন-খাদ্য-আন্দোলন-জমির লড়াই অগ্রজের অটল বিশ্বাস টলিয়ে দেয়।সত্যজিৎ গতির রেখাচিত্র বুঝতে অসুবিধে বোধ করতে থাকেন। যে মূল্যবোধ তাকে গঠন করেছে, তা দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে আকীর্ণ হয়। এই ব্যার্থতা বড় মাপে দেখলে সত্যজিৎ রায়ের একার নয়, তথাকথিত উনিশ শতকীয় চৈতন্যেরই। এনলাইটেনমেন্টের প্রকৃতির মধ্যেই তার সীমাবদ্ধতা। অপূর্ব ও সিদ্ধার্থর পারস্পারিক সম্পর্ক এই সীমাবদ্ধতার একটি স্বীকৃতি।