পথের পাঁচালী’র দেশ / The World of Pather Panchali

in Article
Published on:

Moinak Biswas

Professor, Department of Film Studies, Jadavpur University

বিভূতিভূষণ–সত্যজিতের 'পথের পাঁচালী' শিখিয়েছে 'দেশ' মানে পতাকা আর ম্যাপ নয়, দেশ মানে ঘরের হাঁড়ি–কুড়ি, নারকোল-মালা, রাংতা থেকে ঘাস জল মাঠ বন পরিব্যাপ্ত এক সংসার।

 

পথের পাঁচালীকে আরও একবার স্মরন করার সময় এল। যে ছবি আমাদের সঙ্গেই থেকে গেছে সর্বক্ষন, তার কাছে ফেরত যাওয়ার পথে তাকে নিয়ে নানা বিশ্বাস ও তর্কেরও একটা পুনর্দর্শন জরুরী, শুধু পুনরুক্তি নয়। আমরা বলেছি, এই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেখলাম নিখাদ বাস্তবতার প্রতিলিপি, পরিনত রিয়ালিজম,সাহিত্য-নাটকের দাসত্ব-মুক্ত বিশুদ্ধ ছবির ভাষা।

 

ঠিক কি অর্থে কথাগুলো আজ আর একবার বলব?হয়তো দাসত্ব বা বিশুদ্ধতা নিয়ে উৎকন্ঠা কেটে যাওয়ার পর আজ আবার মনে করতে পারি ‘পথের পাঁচালী’-র সঙ্গে সাহিত্যের এক আধুনিক ঐতিহ্যের আত্মীয়তার কথা।এক বিশেষ জীবনের বাস্তবতা সটান এ ছবির শরীরে প্রবেশ করেনি।মনে করতে পারি অন্য একটা প্রক্রিয়ার কথাঃ এ ছবি ‘পুনরাবিষ্কার’ করেছে এমন এক বাস্তবতাকে, যা বিভূতিভূষনের উপন্যাসে মূর্তি পেয়েছিল।এ শুধু উপন্যাসের বিষয়টাকে পুনর্বার বলা নয়, এক বিশেষ আঙ্গিককে ছবির শরীরে তুলে আনার আয়োজন।

 

সত্যজিৎ লিখছেন, কাহিনিতে আবশ্যিক নয়, জরুরী নয়, এমন কোনো বস্তুর ছবিতে স্থান নেই। খুব সুন্দর কোনো দৃশ্য হাতে আছে,তাই তাকে ছবিতে রাখতে হবে-ওস্তাদ ছবি-করিয়ে এমন বিলাস করতে পারেন না।যুক্তিবাদী ছবির এটাই প্রধান যুক্তি; আখ্যানের ব্যাকরণে কোনও বিশৃঙ্খলা থাকতে পারে না। কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’-তে শুধু কি এই আঁটোসাঁটো কাহিনিকে পাই? নাকি আখ্যানের সংহতির মধ্যেই ক্রমাগত ঢুকে পড়ছে এক ধরনের বিবিরণ,বর্ণনা,সরাসরি কাহিনিতে যার বিশেষ অবদান নেই?এক ধরনের মন্থর অলস চলন,যার আপাত কোনো লক্ষ্য নেই?

 

সত্যজিৎ নিজে একে বলেছেন ramble, বলছেন ছবি করার সময় তিনি জানতেন উপন্যাসের এই ইতস্তত মন্দ চলন তাঁকে অনেকটা ধরে রাখতে হবে; ‘life in a poor Bengali village does ramble’(‘a long time on the Little Road’ ) পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন সাময়িক পত্রে উপন্যাসটির প্রকাশনা-সংক্রান্ত একটি তথ্য।সম্পাদক প্রথমে উপন্যাসটি ছাপতে চাননি,কারন ওতে যথেষ্ট গল্প নেই। শর্ত ছিল,পাঠকের পছন্দ না হলে কয়েক কিস্তির পর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবে। সে সব আশঙ্কা অমূলক প্রমান করেছিলেন পাঠকরা।যথেষ্ট গল্পের অভাব বলতে এক্ষেত্রে এটাই বোঝায় যে, ড্রামাটিক কাঠামোর সঙ্গে বিশুদ্ধ বিবরণ জিনিসটার সম্পর্ক এই উপন্যাসে একটু জটিল।গল্পের প্রত্যক্ষ শাসনের বাইরে ছড়িয়ে যাচ্ছে এক রকমের কথন—সত্যজিৎ সেই কৌশল উপন্যাস থেকে শিখে নিচ্ছেন।ভারতীয় ছবিতে রিয়ালিজম-এর চূরান্ত মুহূর্তে তাকে ভিতর থেকে অগোছালো করে দিচ্ছে এক ধরনের ন্যাচারালিজম।

 

ঘটনাক্রম মেনে তৈরী হয় গড়পড়তা গল্প।‘পথের পাঁচালী’-তে কখনও শুধু দেখছি দিন বা ঋতুর আবর্তন; দেখছি দিনের উত্থান-পতন, স্রেফ সময় বয়ে যাওয়া, আর কিছু নয়। ঘটনা থেকে,চরিত্র থেকে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছি এই প্রবাহকে।দীর্ঘ এক একটা দৃশ্যের বিষয় হয়ে উঠছে সময় নিজেই।এই সব মুহূর্তে ‘পথের পাঁচালী’অপু-দুর্গা-সর্বজয়ার গল্প নয়, সে এক বিশুদ্ধ দেখা, এক পৃথিবীর সাক্ষ্য। সে আলোর, নিসর্গের, হাওয়া ও বৃষ্টির আসা-যাওয়ার,শরীর ধারন করার গল্প।

 

সত্যজিৎ সরাসরি উপন্যাস থেকে তুলে আনছেন এই কৌশল; বিভূতিভূষনের কাছ থেকে শিখছেন কি ভাবে চরিত্র কেন্দ্রিক গল্প বলা, ব্যক্তি চৈতন্যের বিবির্তনের কাহিনিকে অতিক্রম করে পরিবেশকে স্পর্শ করা যায়।পরিবেশ তখন শুধু পটভূমি থাকে না,তার উপস্থিতি ইন্দ্রিয়ময়, জীবন্ত হয়ে ওঠে।

 

গল্পের প্রত্যক্ষ দাবিকে কিছুটা ভুলে ডিটেল-এর অন্য ব্যাবহার করছেন বিভূতিভূষণ ও সত্যজিৎ।ঘরের হাঁড়ি-কুড়ি,নারকোল-মালা রাংতা থেকে ঘাস জল মাঠ বন পরিব্যাপ্ত এক সংসারের অনুপুঙ্খ তৈরী করছেন-সব কিছু ঘিরে থাকা এক অস্তিত্ব রচনা করছেন।নিতান্ত সাধারণ দৈনন্দিনের এই প্রতিলিপি, নিত্যবৃত্তের নথিভুক্তি এক দিকে সময়ের ফিরে ফিরে আসা বৃত্তকে, প্রকৃতিকে ছুঁইয়ে আছে, অন্য দিকে ছুঁইয়ে আছে ইতিহাসের বই-এ বাদ পড়ে যাওয়া, বৃহৎ আখ্যানে ধরা না পড়া এক জীবনযাপনকে।

 

শুধু কাল নয়, এই রকম বিবরণে ক্রমশ স্থান জিনিসটাও শরীর ধারণ করে।একাধিক অর্থে রুপ ধারণ করে দেশ, যে-দেশ দেশাত্মবোধের উচ্চারণে পাওয়া যায় না। রিয়ালিজমের গ্রন্থিগুলো আলগা করে ন্যাচারালিজমের সঞ্চার এক অর্থে এই কাজটাই করছে,দেশপ্রেমের শৃঙ্খলার বাইরে এক দেশকে আবিষ্কার করছে।

 

একটি দৃশ্যের কথা স্মরণ করা যাক।হরিহরের ভিটেয় প্রথম সন্ধ্যার দৃশ্য। প্রথমে দেখি, দিন শেষ হয়ে আবার আলো নেভার পর্ব, প্রান্তর থেকে ক্রমশ গুটিয়ে আসি উঠোনে,দাওয়ায়। প্রথমে শেষ বিকেলের আলো; দূর্গা আর অপু মাঠ থেকে ফিরছে রাঙী গাইকে নিয়ে ঘরে। আকাশে কালো মেঘের চাদর ছিঁড়ে উঁকি দিচ্ছে শেষ সূর্য; বাড়ির দেওয়াল, তার পর উঠোন। থিম সঙ্গীত মিলিয়ে গিয়ে ভেসে আসে পল্লী থেকে উঠে আসা শাঁখের আওয়াজ। উঠোনে, তুলসীতলায় প্রণাম করতে আসে একে একে ইন্দির,সর্বজয়া; চলে যায়। এর পর আরও অন্ধকারে আসি বাড়ির দাওয়ায়। তেলের বাতির আধো আলোয় বসে হরিহর আর অপু লেখাপড়া করছে, গায়ে শিতের চাদর।এক ধারে সর্বজয়া গৃহস্থালীর কাজে ব্যাস্ত।ক্যামেরা বাবা আর ছেলের ওপর এগিয়ে যায়।পাশের দাওয়ার দৃশ্যঃ দূর্গাকে দেখি সেখানে; ইন্দির ঠাকরুণ এসে যোগ দেয়, শতচ্ছিন্ন শীতের কাঁথা নিয়ে বিড়বিড় করে অভিযোগ জানায়।সর্বজয়ার ডাকে দুর্গা চলে আসে অন্য দাওয়ায়; মার হাতে ছোট একটা চড় খায় চুল না-বাঁধার জন্য।অপু হাসে; দুর্গা সর্বজয়ার সঙ্গে চুল বাঁধতে বসে অন্য ধার থেকে তাকে ভ্যাংচায়। অন্য দাওয়ার আধো অন্ধকারে সূচে সুতো পড়াতে গিয়ে বিচিত্র মুখব্যাদান করে ইন্দির।এই দাওয়ায় দেখি চার জনকে।দুর্গা আর সর্বজয়ার কথা হয় চারগাছার বিনুনি নিয়ে, রানুদির বিয়ে নিয়ে।মাঝখানে আর এক বার ইন্দিরের মুখে সুতো ভেজানো, এদের দিকে দৃষ্টিপাত। এর পর হরিহর আর অপুর ওপর নিবদ্ধ হয় দৃষ্টি; দূর থেকে ভেসে আসে ট্রেনের শব্দ; অপুর দিকে এগিয়ে যাই; সে অন্ধকারের দিকে চেয়ে শুনছে সেই শব্দ। দুর্গাকে সে জিজ্ঞেস করে কখনও ট্রেন দেখেছে কিনা। দুর্গা বলে দেখেছে।মা বকুনি দেয় মিথ্যে বলার জন্যে।অপুর প্রশ্ন, দিদি কি জানে রেল লাইনটা কন দিকে; দুর্গা তাকে বলে কেমন করে সেখানে যেতে হয়। দিদি কি তাকে নিয়ে যাবে একদিন? অপুর প্রশ্নের মাঝে হরিহর তার বানান-লেখা স্লেট দেখতে চায়।নতুন শব্দ লিখতে বলে, ‘ঐ ভূত বাপ রে!’

 

সিকোয়েন্সের গোড়ার দিকের মত আর একটি শটে দেখছি বাপ ছেলেকে।ক্যামেরা ট্র্যাক করে পিছিয়ে আসে।চার পাশের অন্ধকারের বৃত্ত আরও বড় হয়, মাঝখানে আলোকিত মঞ্চের মতো দাওয়ায় বসে দুটি প্রাণী।ঝিঝির ডাক গাঢ় হয়ে ওঠে।শেষ হয় দৃশ্য।

 

গোধূলি থেকে সন্ধ্যা হয়ে রাত্রিতে গড়িয়ে যাওয়া একটি দিনই এই দৃশ্যের বিষয়।এই ঘটনাহীন,নাটকহীন মন্থর যাত্রায় সময় শুধু আধার থাকে না, সে ঘন হয়ে ওঠে, শরীর ধারণ করে। ঘটনা নেই, কিন্তু নিরুচ্চারে বলা একটা জীবনযাপনের নকশা রয়েছে। অর্থনৈতিক পরিচয়, সমাজচরিত্র, ভিতরের বৈষম্য(অপু পড়াশোনা করে,গায়ে গরম চাদর; দুর্গার জন্যে নির্দিষ্ট অন্য অবস্থান, একই ঘরের অন্য পাশে)সবই ধরা পড়ছে নকশায়। কিন্তু, দিনলিপির ছন্দ থেকে তা বিচ্যুত নয়, নিসর্গ থেকে আলাদা কোনও ইতিহাস নয়।

 

একটি বিশেষ অবলোকনকে প্রতিষ্ঠা করছে এই সব দৃশ্য, যা দৃশ্যর সঙ্গে এক হয়ে দেখা, সমাজতাত্ত্বিক চিত্রায়ণের রীতি যে তেমন মানে না।আব্বাস কিয়ারোস্তামির ছবির কথা বলতে গিয়ে দার্শনিক জঁ-লুক নান্সি একে বলেছেন ‘চলচ্চিত্রের সাক্ষ্য’ (The Evidence of Film, Abbas Kiaarostami, 2001)যা দিনযাপনের সাক্ষ্য থেকে আলাদা কিছু নয়। চার দিকে ব্যাপ্ত অখন্ড এক অস্তিত্বের মানচিত্র দেখছি। একটা অঞ্চল,জমি ক্রমশ অবয়ব ধারণ করছে।ধ্রুপদি রিয়ালিজম দাবি করে কথক নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখবে কাহিনি থেকে, ক্যামেরা লুকিয়ে রাখবে নিজের উপস্থিতি।‘পথের পাঁচালী’-তে মাঝে মাঝে এক ‘কথক’-এর নিঃশব্দ প্রবেশ ঘটে। কেউ যেন নীরব দেখতে থাকে কাহিনির চরিত্রদের।কাশবনের দৃশ্যে সে ছিল, বৃষ্টির দৃশ্যে ছিল; এই সন্ধ্যার চিত্রমালায় একটু খেয়াল করলেই তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।হরিহরের দাওয়া ঘিরে ঝিঁঝি-ডাকা প্রাণস্পন্দিত অন্ধকারে তাকে অনুভব করা যায়। সন্ধ্যার আসরের শুরুতে ধীরে ক্যামেরা এগিয়ে গিয়েছিল হরিহর আর অপুর ওপর; একেবারে শেষে ঠিক একই পথ ধরে পায়ে পায়ে পিছিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। কেউ যেন একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছে এক গৃহস্থের দিনান্তের মন্থর সব মুদ্রা, খুচরো কথা, নিতান্ত প্রাত্যহিক অভ্যাস। কিছুটা আলোকিত মঞ্চের মত দেখাচ্ছে এই মাটির দাওয়া; একটু দূরেই যেন রয়েছে কোনও দর্শক।

 

বহু প্রাণের অঞ্চল এই অন্ধকারে যে-দর্শক দাঁড়িয়ে, তাকে বিভূতিভূষনের উপন্যাসে পাওয়া যাবে। সেখানে মাঝে মাঝে অপুকে উদ্দেশ্য করে একটি কন্ঠ কথা বলে ওঠে, হঠাৎ তাকে সম্বোধন করা হয় ‘তুমি’ বলে।উপন্যাসে অপু বাবার সঙ্গে বেরিয়ে রেললাইন দেখেছিল, কিন্তু রেলগাড়ি দেখতে পায়নি। সে যখন বিষন্ন হয়ে চলে যাচ্ছে, তখন পড়ছি - ‘তুমি চলিয়া যাইতেছ...তুমি কিছুই জানো না, পথের ধারে তোমার চোখে কী পড়িতে পারে, তোমার ডাগর নবীন চোখ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধায় চারদিককে গিলিতে গিলিতে চলিয়াছে—নিজের আনন্দের এ হিসাবে তুমিও একজন দেশ-আবিষ্কারক...’। এ লেখকের কন্ঠ নয়। কার কন্ঠ তবে? কে কথা বলছে? একটাই উত্তর হতে পারে, এই স্বর উঠে আসছে চারপাশের প্রকৃতি থেকে। একে যদি কোনও নাম দিতেই হয়, তবে সে হবে এক অঞ্চলের নাম, চার পাশের চৈতন্যময় এক দেশ-এর নাম।

 

‘অপরাজিত’ ছবিতে দেখেছি আড়বোয়াল স্কুলে ইনস্পেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে অপু আবৃত্তি করেছিল, ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল’।স্কুলে যাওয়ার পয়সা ছিল না সেই বালকের।তার মুখে ‘সে আমাদের বাংলাদেশ,আমাদেরই বাংলা রে’ শুনে ঝাঁটাগুঁফো, কৃষ্ণকায়, বর্তুল ইনস্পেক্টর সাহেবের মুখ অনিন্দ্য হাসিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল।

 

এই স্নিগ্ধ ক্যারিকেচারের মধ্যে দিয়ে যে—দেশের কথা শুনি, তা জাতি-রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নাগরিক কোনও কিশোর নায়কের দেশপ্রেম নয়, দরবারী নাগরিক হতে গিয়ে ক্রমশ যে-দেশ অপসৃত হয়, এ তার বিবৃতি। বেশ কয়েক বছর পরে আমলকি আর হরতুকি গ্রামের দুই চাষার ছেলে শুন্ডিরাজার সভায় গিয়ে দরবারি সঙ্গীত ছাপিয়ে তাদের ঘুম-তাড়ানো গানে জানিয়েছিল,‘মহারাজা,তোমারে সেলাম।মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম’।সেই কথা শুনে শুন্ডিরাজার মুখে আর এক বার দেখা গিয়েছিল পরম আহ্লাদের হাসি।