ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বিষ্ণুপুর ঘরানা

in Overview
Published on:

শর্মিষ্ঠা (Sharmistha)

ছেলেবেলা ও স্কুলজীবন কেটেছে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরে।
ইনফরমেশন টেকনলজিতে বি.টেক করার পর তিন বছর কাজ করেছেন সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে - কগনিজেন্ট টেকনলজি সলিউশনসে। তারপর চাকরি ছেড়ে লেখালেখি করতে আসা। প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘স্পর্ধা’ (দেশ ২০১৫) প্রথম ছোটোগল্প ‘না পৌঁছনো মানুষ’ (দেশ - ২০১৬)। বিভিন্ন বাংলা পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। পছন্দের বিষয় ইতিহাস এবং বিশ্বসাহিত্য।

ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসে বিষ্ণুপুর ঘরানা একটি উজ্জ্বল নাম। বাংলার একমাত্র এবং নিজস্ব এই ঘরানা ধ্রুপদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকাল (পঞ্চদশ শতাব্দী) থেকে শুরু করলে, বিষ্ণুপুরের সঙ্গীত চর্চার কাল প্রায় ছ’শ বছরে পৌঁছেছে।[i] কথকতা এবং কীর্ত্তনের চর্চার কারনে, জনজীবনে সঙ্গীতের একটি পরিমন্ডল তৈরীই ছিল। কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চল তখনও ছিল না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা শুরু হয় আদিগুরু রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের (১৭৬১-১৮৫৩) সময়কাল থেকে। এই সুদীর্ঘ সময়ে সহস্রাধিক কৃতি সঙ্গীতজ্ঞ বিষ্ণুপুর ঘরানায় তাঁদের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলার রাগসঙ্গীত চর্চার উৎসমুখ জানতে হলে নিশ্চিতভাবেই ফিরে তাকাতে হবে বিষ্ণুপুর ঘরানার দিকে। আবার এই ঘরানাই ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলিরও উৎস নির্দেশ করে।

UNESCO ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট, ‘মন্দির নগরী’, মল্লভূম বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যময় ইতিহাস - একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতিরই ইঙ্গিতবাহী। (Fig.1) সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বাঙালী সংস্কৃতির পীঠস্হান ছিল বিষ্ণুপুর। স্হাপত্য ও ললিতকলার স্বর্নযুগের সমাপতন লক্ষ্য করা যায় বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের দিকে তাকালে। বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎস, ইতিহাস, স্বকীয়তা, প্রজন্মক্রমে কৃতি সঙ্গীতজ্ঞদের অবদান ছাড়াও ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে বিষ্ণুপুর ঘরানার সেকাল ও একালকে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরতে চাওয়াই এই প্রকল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয়।

 

Fig.1.বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দির। কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

 

বাংলা তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই অভিনব অধ্যায়কে ইতিহাস ও বর্তমানের আলোতে পর্যালোচনা করা এবং পরিশেষে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়াই এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার বিকাশে বৈষ্ণব ধর্ম ও শাস্ত্রীয় কীর্ত্তণের প্রভাব

বাঙালীর সঙ্গীতের একমাত্র ঘরানা - বিষ্ণুপুর ঘরানার ইতিহাস সুদীর্ঘকাল ধরে প্রবাহিত এবং সুপ্রশস্তএই ইতিহাসের যথার্থ সংরক্ষণ এবং মূল্যায়ন প্রয়োজন

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাসের সময়কাল (১৩৭০ খ্রীষ্টাব্দ) থেকে বিষ্ণুপুর ঘরানার আদি পর্বের সূচনা বলা যেতে পারে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীতগোবিন্দের আদর্শে বাংলা ভাষায় রচিত, রাগ-তালে নিবদ্ধ প্রথম কাহিনি কাব্য যা একই সাথে কাব্য ও গীতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট। বড়ু চন্ডীদাস (১৩৭০ - ১৪৩৩) রচিত এই পুঁথিটি ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় আবিষ্কার করেন। পুঁথিটি বন-বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা নিবাসী দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে ছিল। এটি গ্রন্থ আকারে কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে[ii]

চৈতন্যদেবের (১৪৮৬ - ১৫৩৩) সময়কালে বৈষ্ণব ধর্ম তথা ভক্তিবাদের প্লাবন আসে বাংলায়। (Fig. 2) চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর বৈষ্ণব সমাজ কিছুকাল স্তিমিত হয়ে পড়েপরবর্তীকালে মল্লরাজ বীর হাম্বীরের শাসনকালে (১৫৮৬ – ১৬২০) শ্রীনিবাস আচার্য (জন্ম - ১৫১৬) শাস্ত্রীয় কীর্ত্তন ও শাস্ত্রীয় কথকতায় মল্লরাজসভা বিজয় করলে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণবধর্মের পুনরুত্থান ঘটে[iii] অনেকে মনে করেন খেতুরির মহোৎসবে নরোত্তম দাস উদ্ভাবিত শাস্ত্রীয় কীর্ত্তন থেকেই বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রবর্তন ঘটে।

 

Fig.2.প্রাচীন পুঁথির পাটাচিত্রে বৈষ্ণব আচার্যগণ। (কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী)

 

বিষ্ণুপুরে যিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রচার এবং প্রসার ঘটান সেই শ্রীনিবাস ছিলেন নরোত্তম দাসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। এই নরোত্তম ঠাকুর বৃন্দাবনে অবস্হানকালে তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামীর কাছে প্রায় ছয় সাত বছর ধরে ধ্রুপদ শিক্ষা করেন। বৃন্দাবন থেকে, পুঁথির গাড়ি নিয়ে,গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের গোস্বামী সিদ্ধান্তের প্রচারের জন্য গৌড়ে আসছিলেন শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ। বিষ্ণুপুরের কাছে গোপালপুরে পুঁথি চুরি হয়। পরে সে পুঁথি মল্লরাজ বীর হাম্বির আচার্য শ্রীনিবাসকে প্রত্যর্পন করেনআচার্য শ্রীনিবাস রাজা বীর হাম্বিরকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দেন ও বিষ্ণুপুরে রয়ে যান। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য কীর্ত্তণ ও কথকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

বিষ্ণুপুরে, সংগীতের বিকাশ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অভ্যুত্থানের পাশাপাশিই ঘটছিলনরোত্তম দাসের শাস্ত্রীয় কীর্ত্তন শ্রীনিবাসের উদ্যোগে বিষ্ণুপুরে আসে। ডাঃ সুকুমার সেনের মতে, রাজাদের একাধিক ঠাকুরবাড়িতে কীর্ত্তনের সমারোহ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। অন্যদিকে বৃন্দবনী কথকতা ছিল মার্গসংগীত ভিত্তিক। শাস্ত্রীয় কীর্ত্তন ও কথকতাই ছিল বিষ্ণুপুরে মার্গসংগীতের সাম্ভাব্য উৎসমুখ (দাসগুপ্ত ২০১৪)[iv]

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎস

মুঘল সম্রাট আউরঙ্গজেবের শাসনকালে (১৬৫৯-১৭০৭) ইসলামি কট্টরপন্থা চূড়ান্ত রূপ নেয়। বহু গুনী মানুষ তাঁর দরবার ছেড়ে চলে যান। প্রচলিত মতানুসারে, তানসেনের বংশধর ওস্তাদ বাহাদুর খান এবং মৃদঙ্গ বাদক পীর বক্স এসময় দিল্লীর দরবার ছেড়ে চলে আসেন বিষ্ণুপুরে, তৎকালীন মল্লভূমের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ দেবের (১৭০২-১৭১২) দরবারে। মল্লরাজার দরবারে তিনি সভাগায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন।

বিষ্ণুপুর ঘরানার আদিপুরুষ পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে (১৭৬১-১৮৫৩) ওস্তাদ বাহাদুর খানের শিষ্য বলে অনেকে মনে করেন। সে হিসেবে সেনিয়া ঘরানার সাথে বিষ্ণুপুর ঘরানার সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে অনেক ভিন্নমত আছে। শ্রী দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায় সন তারিখ বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন যে, বাহাদুর খাঁ মল্লভুমে আসেন ১৭০৭ এর পূর্ববর্তী কোনো সময়, আর রামশঙ্কর ভট্টাচার্য্যের সময়রেখা শুরুই হচ্ছে এর চুয়ান্ন বছর পর।

শ্রী দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৬৩) প্রতিষ্ঠিত মতটি হলো, মথুরা-বৃন্দাবন সংগীত কেন্দ্রের আচার্য স্থানীয়, পণ্ডিতজীনামক জনৈক গায়ক পুরীধামে তীর্থযাত্রার সময় বিষ্ণুপুর রাজ চৈতন্য সিংহের (১৭৪৮-১৮০১) দরবারে কয়দিন থাকেন ও রাজার সভাপণ্ডিত গদাধর ভট্টাচার্যের ছেলে তরুণ গায়ক রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে অনুপ্রাণিত করেন। ফেরার পথে তিনি ওই দরবারে দুই বৎসরকাল অবস্থানকালে রামশঙ্করকে ধ্রুপদ শিক্ষাদান করেন।

আর একটি মত প্রতিষ্ঠা করেছেন সঙ্গীতাচার্য্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রকৃত ইতিহাস ও রাগরূপের সঠিক পরিচয়’ গ্রন্হেতিনি বলেছেন রামশঙ্কর পশ্চিম থেকে আগত খুব বড়ো এক হিন্দুস্হানী ধ্রুপদ গায়কের কাছে শিক্ষা করেন, তারপর সেই গায়কের সঙ্গে চলে যান। তাঁর কাছে অনেকদিন থেকে ধ্রুপদ শিক্ষা করেন। পরে সেই স্হানের একজন ওস্তাদ খেয়াল গায়কের কাছে খেয়াল ও টপ্পা গান শিখে বিষ্ণুপুরে ফিরে আসেন[v]

রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের গুরু কে, সেই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনিই যে বিষ্ণুপুর ঘরানার ভিত প্রতিষ্ঠাতা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার বৈশিষ্ট্য

ধ্রুপদ – ভারতীয় রাগসঙ্গীতের একটি প্রাচীনতম ধারা। 'ধ্রুপদ শব্দটিধ্রুবপদশব্দের অপভ্রংশধ্রুব অর্থ স্থির, ঋজু, শান্ত, শাশ্বত সত্যপদঅর্থ গীতি বা গান ধ্রুবপ্রবন্ধ বা প্রবন্ধগীতি থেকে ধ্রুবপদের উৎপত্তি

ধ্রুবপদবাধ্রুপদবলতে এক প্রকার ধীর, স্থির, গম্ভীর সঙ্গীতকে বোঝায় একই সাথে আধ্যাত্মিক ও রাজকীয় তার চলন। প্রাচীনকালে ধ্রুবপদের ভাষা ছিল আধ্যাত্মিক ও অপূর্ব মহিমাময়। ঈশ্বরের বন্দনামূলক এইসব ধ্রুবপদ উৎকর্ষ ও জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয়। পরবর্তীকালে ধ্রুবপদের বিষয় ও ভাষা ক্রমশ লঘু হয়ে আসে। ঋতু বন্দনা, প্রকৃতি বন্দনা, রাজা-মহারাজাদের প্রশস্তিমূলক ধ্রুবপদ তাঁর একসময় অর্জিত মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা হারায়[vi]

সম্রাট আকবরের সময়কালে চারপ্রকার প্রবন্ধগীতির বানী প্রচলিত ছিল। গৌড়বার, খান্ডার, ডাগর ও নৌহার। বিষ্ণুপুর ঘরানার পন্ডিত সুজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদের সাথে ডাগর বানীর ধ্রুপদের কিছু কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বৃন্দাবনে, স্বামী হরিদাসের শিষ্যগন ডাগর বানীর ধ্রুপদ চর্চা করেন। ডাগর বানীর ভাষা মনোমুগ্ধকর, কমনীয়, মধুররস অথবা করুণরসে সম্পৃক্ত।

বিষ্ণুপুর ঘরানার পৃষ্ঠপোষক মল্লরাজাগন বংশানুক্রমে ছিলেন ভক্ত বৈ‍ষ্ণব এবং মন্দির অন্ত প্রাণ। (Fig. 3) তাঁরা প্রায় দেড়শত মন্দির তৈরী করেছিলেন আর এইসব মন্দিরে ইশ্বরের আরাধনার জন্য গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদে ভক্তি ও প্রেমভাবেরই প্রাবল্য।ওস্তাদি ইচ্ছাকৃতভাবেই অন্যান্য ঘরানার অনুপাতে কম। সেজন্য কিছুটা নিরলঙ্কার।

 

Fig. 3. টেরাকোটা প্যানেলে সংগীতের উদযাপন (কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী)

এখানে প্রথমে তোম নোম সহযোগে আলাপের মাধ্যমে রাগের ধ্যানরূপ ফুটিয়ে তুলে, তারপর পাখোয়াজের সঙ্গতে চারতুকের ধ্রুপদ গাওয়া হয়। ওস্তাদির ঔদ্ধত্ব না দেখিয়ে, ভক্তি ও নিবেদনের ভাব বজায় রেখে, ঈশ্বর আরাধনা করাই এ ঘরানার বৈশিষ্ট্য। ধ্রুপদের আদি ও মূল উদ্দেশ্য, ঈশ্বরবন্দনা – বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদে সার্থকভাবে সাধিত হয়েছে এখনও বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদে সেই ঈশ্বরপ্রেম ও নিবেদনের রূপ অবিকৃতভাবে রক্ষিত হচ্ছে।

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার কৃতি সঙ্গীতজ্ঞদের গুরুশিষ্য পরম্পরা

রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের(১৭৬১-১৮৫৩) পর গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই ঘরানা আবর্তিত হয়েছে কন্ঠসংগীতে মূলত ধ্রুপদ, ধামার, তারানা, খেয়াল, ত্রিবট, চতুরঙ্গ, টপ্পা, ঠুংরী এবং যন্ত্রসংগীতে মূলত বীণা, সুরবাহার, সেতার, এস্রাজ, জলতরঙ্গ, ন্যাসতরঙ্গ, মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজকে কেন্দ্র করে। (Fig. 4) রামশঙ্কর বাংলায় ধ্রুপদ রচনায় ব্রতী হন এবং তারই প্রভাবে বিষ্ণুপুরে খেয়ালের ধারার সূত্রপাত হয়। সঙ্গীতাচার্য্য রামশঙ্কর বিরানব্বই বছর জীবিত ছিলেন এবং দীর্ঘ জীবনে তিনি বিষ্ণুপুর ঘরানার একটি বৈশিষ্ট্যময় রূপরেখা প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন।

 

Fig. 4. প্রাচীন তারযন্ত্র  (কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী)

 

রামশঙ্কর ভট্টাচার্য্যের প্রতিভাবান ও মহান শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন পুত্র রামকেশব ভট্টাচার্য্য, ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, অনন্তলাল বন্দোপাধ্যায়, যদুভট্ট (যদুনাথ ভট্টাচার্য্য) প্রমূখ। রামশঙ্কর বিষ্ণুপুরে অবস্থান করলেও তার শিষ্যরা ক্রমে বাংলার নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। এদের পর এই ঘরানার ভার ন্যাস্ত হয় রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সঙ্গীতগুণীদের ওপর। এই ধারায় তারপর আসেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র প্রকাশ গোস্বামী, গোকুল নাগ (সেতার), অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় (সেতার, সুরবাহার, এস্রাজ) প্রমুখ। মৃদঙ্গ বাদ্যে যারা সুনাম অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে জগৎচাঁদ গোস্বামী, নৃত্যানন্দ গোস্বামী, কীর্তিচন্দ্র গোস্বামী, জগন্নাথ মুখোপাধ্যায়, শ্রীপতি অধিকারী, ইশ্বরচন্দ্র সরকার প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য।

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার শাখাপ্রশাখা

গুরুশিষ্য পরম্পরায় বিষ্ণুপুর ঘরানা যে ধারায় পল্লবিত হয়েছে তার সমগ্ররূপ এই স্বল্পপরিসরে যতটা সম্ভব তুলে ধরা হয়েছে। (Fig. 5)

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার শাখা-প্রশাখার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ। কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

 

ভারতীয় সংগীতে বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞদের অবদান

রামকেশব ভট্টাচার্য্য (১৮০৮-১৮৫০) সর্বপ্রথম বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ গানকে বিষ্ণুপুরের বাইরে কলকাতা এবং কোচবিহার সহ বাংলার বিস্তীর্ন এলাকায় প্রসারিত করেন। ধ্রুপদে পারদর্শিতা ছাড়াও তিনি ছিলেন এস্রাজের এক গুনী শিল্পী বিষ্ণুপুরে ময়ূরমূখী এস্রাজ বা তাউস যন্ত্রের প্রচলন করেন তিনি।

সঙ্গীতাচার্য্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের শিষ্য ‘সঙ্গীতনায়ক’ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী(১৮২৩-১৮৯৩) মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে কলকাতার সঙ্গীত সমাজে বিপুল প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পাথুরিয়াঘাটায় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন তাঁর সঙ্গীতসভায় ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীকে গায়ক নিযুক্ত করেন। এখানেই তিনি বীণকার লক্ষ্মীকান্ত মিশ্রের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। গুরুশিষ্যের মিলিত উদ্যোগে ১৮৬৭ সালে কলকাতায় এক বড়ো মাপের সঙ্গীতসভা আয়োজিত হয়। এখানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গীতগুনীরা সঙ্গীত বিষয়ে নিজ নিজ অভিমত প্রকাশ করেন। এইসব মতের সমন্বয় ঘটিয়ে ক্ষেত্রমোহন তাঁর ‘সঙ্গীতসার’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্হে ভারতীয় রাগগুলিকে সূত্রবদ্ধ করে প্রকাশ করেনএছাড়াও তিনি ঐকতানিক স্বরলিপি, গীতগোবিন্দের স্বরলিপি (জয়দেব বিরচিত গানের স্বরলিপি), কন্ঠকৌমুদী (ধ্রুপদ,খেয়াল এবং টপ্পা গানের স্বরলিপির একটি বড়ো সংকলন) এবং আশুরঞ্জনী তত্ত্ব(বাংলা ভাষায় রচিত এস্রাজ শিক্ষা সম্পর্কিত আদি গ্রন্হ) প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্হ রচনা করেন। দন্তমাত্রিক স্বরলিপির আবিষ্কারক ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর শিষ্যমন্ডলীর মধ্যে দেশজোড়া খ্যাতির অধিকারী হন শৌরীন্দ্রমোহন ‌ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সকলেই বিষ্ণুপুরী চালের গায়ক বলে পরিচিত ছিলেন।

সঙ্গীতকেশরী অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩২-১৮৯৬) তাঁর গুরু রামশঙ্করের আদর্শ অনুসরণ করে সারা জীবন বিষ্ণুপুরে থেকে অসংখ্য শিষ্যকে বিষ্ণুপুর ঘরানায় পারদর্শী করে তোলেন। তিনি ছিলেন মল্লরাজ দ্বিতীয় গোপাল সিংহ ও পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ সিংহের সভাগায়ক। সেসময় মল্লরাজ্যের নিতান্তই ভগ্নদশা। কিন্তু একাধিক রাজা, মহারাজা, ধনী জমিদারদের সঙ্গীতসভায় স্হায়ীভাবে যোগদানের শত প্রলোভন স্বত্ত্বেও তিনি গুরুর পথ অনুসরণকেই শ্রেয় মনে করেছেন। তাঁর বিপুল সংখ্যক ছাত্রের মধ্যে কয়েকজন কৃতবিদ্য সঙ্গীতজ্ঞ – রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, হারাধন দেবঘরিয়া, অম্বিকা চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

যদুনাথ ভট্টাচার্য্য (১৮৪০-১৮৮৩), যিনি পরবর্তীকালে ‘তানরাজ’ ‘রঙ্গনাথ’ যদুভট্ট নামে বাংলা তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এক যুগান্তকারী পুরুষ হয়ে উঠবেন তাঁর সঙ্গীতচর্চার হাতেখড়ি হয় বিষ্ণুপুর ঘরানা শিক্ষার মধ্য দিয়ে। শৈশব ও কৈশোরে যদুভট্টের সঙ্গীতচর্চার প্রথম ভিত তৈরী হয় সঙ্গীতাচার্য্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের শিক্ষায়। বিষ্ণুপুরে থাকাকালীন পিতা মধুভট্টের কাছে শেখেন সেতার, সুরবাহার ও পাখোয়াজ। তারপর তিনি খান্ডারবানী ধ্রুপদ শিক্ষা করেন কলকাতার বিখ্যাত সঙ্গীতগুনী গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। ক্রমে ক্রমে দিল্লী, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, বেনারস বিভিন্ন শহর ঘুরে ভারতবর্ষের আরও অন্যান্য ঘরানা শিক্ষা করেন। তিনি শুধু অসামান্য ধ্রুপদ গায়কই ছিলেন না ছিলেন প্রসিদ্ধ পাখোয়াজিও। অসংখ্য উচ্চমানের বাংলা ও হিন্দি ধ্রুপদ তিনি রচনা করেন। এই ধ্রুপদগুলি ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতগুলির অন্যতম প্রেরণা। এরকম ওস্তাদ বাংলাদেশে জন্মায়নি – এই ছিল যদুভট্ট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতযদুভট্ট যদিও অন্যান্য ঘরানা শিক্ষা করেন ও মূলত খান্ডারবানী ধ্রুপদ গেয়েই খ্যাতিমান তবু তাঁর গানে যে আত্মসমাহিত নিবেদনের ভাব, তা প্রথম জীবনের শিক্ষা বিষ্ণুপুর ঘরানারই দান।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাগুরু রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর(১৮৬৩-১৯২৪) সঙ্গীত সাধনায় বিষ্ণুপুর ঘরানা, খান্ডারবানী ঘরানা ও বেতিয়া ঘরানার ত্রিবেণী সংগম ঘটেছিল। প্রথমজীবনে বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতকেশরী অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও সঙ্গীতাচার্য্য দীনবন্ধু গোস্বামীর কাছে সঙ্গীত শিক্ষা করেন। বিষ্ণুপুরী চালের বহু গান তাঁর সংগ্রহে ছিল। পরবর্তীকালে বিষ্ণপুর ও কলকাতায় যদুভট্টের কাছে কিছুকাল খান্ডারবানী ধ্রুপদ শিক্ষা করেন। আবার দশ বছরেরও বেশী সময় ধরে বেতিয়া ঘরানা শিক্ষা করেন দুই দিকপাল শিক্ষাগুরু শিবনারায়ন মিশ্র ও গুরুপ্রসাদ মিশ্রের কাছে। এই তিন ঘরানার সমৃদ্ধ সঞ্চয়ই তাঁর বিপুল সঙ্গীতভান্ডারের উৎস।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রনে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ছাড়াও রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী ছিলেন ঠাকুরবাড়ীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষকতাঁর সম্পর্কে সংগীতচিন্তায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কেবল যে গানের সংগ্রহ ও রাগিনীর রূপজ্ঞান ছিল তা নয়। তিনি গানের মধ্যে বিশেষ একটি রস সঞ্চার করতে পারতেন। সেটা ছিল ওস্তাদির চেয়ে বেশি[vii] তিন ঘরানার রীতিতে প্রশিক্ষিত হলেও রাধিকাপ্রসাদ আসরে গাওয়ার সময়, বিষ্ণুপুরী উচ্চারণে, প্রধানত বেতিয়া ঘরানাকেই অনুসরণ করতেন |[viii]

‘সঙ্গীতাচার্য্য’ রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭১-১৯২৯) ধ্রুপদ,পাখোয়াজ ও তবলা শিক্ষা করেন পিতা অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। পরে গোপালচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে ধ্রুপদ শিক্ষা করলেও তিনি বিষ্ণুপুরী চালের গায়ক হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন। (Fig. 6) বুন্দেলখন্ডের কিংবদন্তী শিল্পী মহম্মদ খাঁর কাছে রামপ্রসন্ন দুই আঙুলে সেতারবাদন শেখেন ও তাতে দক্ষতা অর্জন করেন। ক্রমে পাখোয়াজ, সুরবাহার, সেতারবাদক ও সঙ্গীতগুনী হিসাবে তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৩ সালে রামপ্রসন্ন রচনা করেন ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরী এই চার শ্রেনীর সঙ্গীত যাতে সাধারন মানুষ শিক্ষা করতে পারে তার জন্য বহু শ্রম করে তিনি এ সমস্ত গানের নির্ভূল স্বরলিপি রচনা করেন। এছাড়াও তিনি রচনা করেন সঙ্গীত বিষয়ক আরও তিনটি গ্রন্হ – মৃদঙ্গ দর্পন, এসরাজ তরঙ্গ এবং তবলা দর্পণ। বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত করে।

অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৮০-১৯৬৩) সঙ্গীতচর্চার সূচনা হয় তাঁর পিতার কাছেই। তারপর বেতিয়া ঘরানার বিশিষ্ট উত্তরাধিকারী গুরুপ্রসাদ মিশ্রের কাছে ধ্রুপদ, খেয়াল ও টপ্পায় বেশ কয়েকবছর তালিম নেন। বেতিয়া ঘরানা শিক্ষা করলেও তিনি বিষ্ণুপুরী চালের গায়ক হিসাবেই সারা ভারতে খ্যাতিলাভ করেন।‘গীতসম্রাট’,‘সংগীত নায়ক’ প্রভৃতি উপাধি পান তিনি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে ‘স্বর সরস্বতী’ উপাধি প্রদান করেন। নাড়াজোলের রাজা দেন তানরাজ ও কুচিয়াকোলের রাজা দেন সুররাজ উপাধি। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ও ব্রজভাষায় বহু সঙ্গীত রচনা করেন। বর্ধমান মহারাজের স‌ভায় তিনি দীর্ঘকাল সভাগায়ক ছিলেন। তাঁর রচিত -‘সঙ্গীত চন্দ্রিকা’(প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ),‘ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস’, ‘বহুভাষাগীত’, ‘সঙ্গীতলহরী’, ‘গীতমালা’, ‘তানমালা’, ‘গীতদর্পণ’, ‘গোপেশ্বর গীতিকা’ প্রভৃতি গ্রন্হ ভারতীয় সঙ্গীত সাহিত্য ও গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে। সঙ্গীতে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে বিশ্বভারতী থেকে ১৯৬১ সালে তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেওয়া হয়।

অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র ‘পদ্মশ্রী’, ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬-১৯৭২) ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যতম দিকপাল শিল্পী। একদিকে যেমন কন্ঠসঙ্গীতে ধ্রুপদ, ধামার ও টপ্পা শিখেছিলেন দুই অগ্রজ – রামপ্রসন্ন ও গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অন্যদিকে যন্ত্রসঙ্গীতে জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শেখেন সেতার, সুরবাহার ও এস্রাজএছাড়া ন্যাসতরঙ্গ, নৌকাতরঙ্গ ও পাখোয়াজেও তিনি ছিলেন কুশলী শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের বহু গানের স্বরলিপি প্রস্তুত করেন তিনি। স্বরলিপি তৈরীর ব্যাপারে তাঁর ছিল অনায়াস দক্ষতা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘স্বরলিপির যাদুকর’ আখ্যা দেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতাচার্য্যের পদে বহুবছর ছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি বর্ধমান মহারাজের রাজসভায় এবং কলকাতার মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের রাজসভায় সভাগায়করূপে ছিলেন। ‘সুরেশ্বরী’ ও ‘গান্ধী’ নামের দুটি রাগ তিনি সৃষ্টি করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘গীত পরিচয়’, ‘এস্রাজ মুকুল’ এবং ‘সেতার শিক্ষা’ একসময় খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

 

Fig.6.অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চার সংগীতগুনী পুত্র :  উপরে: রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁদিকে: গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় নীচে: রামকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডানদিকে: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৮০) সঙ্গীতে এক বিরল প্রতিভার নাম। কাকা গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি শেখেন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি এবং সেতার। এছাড়াও বাঁশি, সুরবাহার, বীনা, এস্রাজ, ব্যাঞ্জো, পাখোয়াজ, জলতরঙ্গ প্রভৃতি যন্ত্রবাদনে তিনি সুদক্ষ ছিলেন। তিনি বাংলাভাষীদের মধ্যে খেয়ালকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বাংলায় শতাধিক খেয়াল রচনা করেন। বাংলা খেয়াল ছাড়াও সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অসংখ্য রাগে বহু উৎকৃষ্ট সঙ্গীত রচনা করেন। তিনি ‘সঙ্গীত মুকুর’, ‘সঙ্গীত জ্ঞান প্রবেশ’, ‘বাঙ্গালা ভাষায় উচ্চাঙ্গ খেয়াল’ এবং ‘গীত চলন্তিকা’ প্রভৃতি বহু মূল্যবান সঙ্গীত গ্রন্থের রচয়িতা।

বিষ্ণুপুর ঘরানার আর এক সার্থক উত্তরসাধক গোকুল চন্দ্র নাগ (১৯০৬-১৯৮৩) ‘সঙ্গীতাচার্য্য’ রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রিয় শিষ্য ছিলেন। বিষ্ণুপুর ঘরানাকে যে সমস্ত শিল্পী সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছেন গোকুল  নাগ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মূলত সেতারশিল্পী হলেও ধ্রুপদ, খেয়াল, এস্রাজ ও ন্যাসতরঙ্গে ছিল অনায়াস দক্ষতা। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ এই তিন বছর তিনি উদয়শঙ্করের নৃত্যগোষ্ঠীর সাথে সারা ভারত পরিক্রমা করেন। উদয়শঙ্করের দলে থাকার সময় তিনি বেশ কিছুদিন কিশোর রবিশঙ্করকে সেতারে তালিম দেন। পন্ডিত রবিশঙ্করের সেতার বাদনের ভিত গোকুল চন্দ্র নাগের প্রভাবেই শক্তভাবে নির্মিত হয়[ix]

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য্য শ্রীনিবাসের উত্তরপুরুষ জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী (১৯০২-১৯৪৫) খুব অল্প বয়সেই পিতৃহীন হন। প্রথম সঙ্গীতগুরু পিতৃব্য লোকনাথ গোস্বামী, দ্বিতীয় গুরু সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়তারপর কাকা রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছে ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত চলে সুদীর্ঘ সাধনা। রাধিকাপ্রসাদের মৃত্যুর পর তিনি বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকর, আবদুল করিম খাঁ, বাদল খাঁ, জমিরুদ্দীন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ এতগুলি গুরুর কাছে বিচ্ছিন্নভাবে তালিম নেন। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গানে সবচেয়ে বড়ো সম্পদ ছিল তাঁর ওজস্।  ধ্রুপদ, খেয়াল ও টপ্পা এই ত্রিবিধ সুরলোকেই ছিল তার অবাধ বিচরণ[x]  ধ্রুপদ, খেয়াল ও খেয়াল ভাঙা বাংলা গানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের বাংলা গান গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে অখন্ড বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রায় একার চেষ্টায় রাগভিত্তিক বাংলা গানকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ

আচার্য্য অশেষ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৯২) মাত্র সতের বছর বয়সে বিশ্বভারতীতে কন্ঠসঙ্গীতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। প্রথম গুরু পিতা রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে দুই কাকা গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিষ্ণুপুর ঘরানা শিক্ষা করেন। সেতার, বেহালা, সুরবাহার, তবলা এসবে নৈপুন্য থাকলেও এস্রাজবাদনের জন্যই তিনি কিংবদন্তীতে পরিনত হয়েছেন। তাঁর অভিনব ও উন্নত বাদনশৈলী এস্রাজ যন্ত্রকে সহযোগী বাদ্যযন্ত্র থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে একক বাদনের স্তরে উন্নীত করেছে। দীর্ঘকাল আকাশবানীতে তিনি সেতার ও এস্রাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অভিনীত ও পরিচালিত গীতিনাট্যগুলির আবহসঙ্গীতে এস্রাজি অশেষ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিশ্বভারতীতে শিক্ষাদান করে অশেষচন্দ্র বহু গুণী ছাত্রছাত্রী তৈরী করেন।

সর্ব-সাধারনের সঙ্গীত শিক্ষার জন্য বিষ্ণুপুরে, ১৮৮৫ সালে, রামশরণ মুখোপাধ্যায় প্রতি‌ষ্ঠা করেন রামশরণ মিউজিক স্কুল যা পরবর্তীকালে (১৯৪৩) রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় বা মিউজিক কলেজে রূপায়িত হয়।

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার বিকাশে মল্লরাজাদের ভূমিকা

উত্তরে দামোদর ও দক্ষিনে শীলাবতী নদীর মধ্যবর্তী ভূখন্ডে(বর্তমানে বাঁকুড়া জেলায়) মল্লভূমের অবস্হান। মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুর। এখানে রাজত্ব করতেন মল্লবংশীয় রাজারা। বৈষ্ণবাচার্ষ্য শ্রীনিবাসের প্রভাবে রাজা বীর হাম্বীর গৌড়ীয় ধর্মমতে দীক্ষা গ্রহন করেন। তার পর থেকেই মল্লবংশীয় রাজারা হয়ে ওঠেন পরম বৈষ্ণব। ইষ্টদেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মল্লরাজারা সপ্তদশ শতকের প্রথম থেকে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় দেড়শত মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মল্লরাজ বীর হাম্বির রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার উদযাপনের জন্য নির্মান করেন পিরামিডাকৃতি সুবিশাল রাসমঞ্চ। মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ নির্মান করেন শ্যামরায়, জোড়বাংলা এবং কালাচাঁদের মতো অপূর্ব এবং বিস্ময়কর স্হাপত্য।

মন্দির স্হাপত্য অবলম্বন করে পোড়ামাটির ভাস্কর্যশিল্প বিকাশ লাভ করে। পোড়ামাটির ফলক, চিত্রিত ইঁট দিয়ে মন্দিরের দেওয়াল অলংকৃত করা হতো। (Fig. 7) গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চার একটি প্রধান অঙ্গ বিদ্যাচর্চা। এই সূত্রে বিষ্ণুপুর সংস্কৃত ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠল। মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে বহু সংস্কৃত ও বাংলা গ্রন্হ রচিত হয়। প্রচলিত প্রথা অনুসারে পুঁথির পাটা বা কাঠের মলাট চিত্রিত করা হতো। পাটা চিত্রণের সূত্রে চিত্রশিল্পেরও একটি স্বতন্ত্র ঘরানার সৃষ্টি হয়।

 

Fig.7.টেরাকোটা প্যানেলে সংগীতের উদযাপন। কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

 

প্রায় দুইশত বছরের বৈষ্ণব ধর্মচর্চার সূত্রেই বিষ্ণুপুরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসার ঘটে। উচ্চাঙ্গের গরাণহাটি ও মনোহরসাহী কীর্ত্তণে বিষ্ণুপুরের কীর্ত্তণীয়ারা বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। সঙ্গীতচর্চার আরও প্রসার ঘটে অষ্টাদশ শতকে। মহারাজ চৈতন্য সিংহ, প্রতিভাবান তরুণ গায়ক রামশঙ্কর ভট্টাচার্য্যকে (যিনি পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুর ঘরানার স্রষ্ঠা হয়ে উঠবেন) মল্লরাজসভার সভাগায়ক নিযুক্ত করেন সঙ্গীতাচার্য্য রামশঙ্করের দেহাবসান ঘটলে, তাঁর শিষ্য সংগীতকেশরী অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মল্লরাজ দ্বিতীয় গোপাল সিংহের সময় সভাগায়কের পদে অভিষিক্ত হন। এভাবে মল্লরাজাদের বৈষ্ণবধর্মপ্রীতির পরোক্ষ প্রভাব ও সঙ্গীতের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে মার্গ সঙ্গীতের একটি পৃথক ঘরানা সৃষ্টি হয়।   

 

বাংলা সঙ্গীতের রূপরেখা তৈরীতে বিষ্ণুপুর ঘরানার ভূমিকা

অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ, সঙ্গীতাচার্য্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্য্য ‌অখন্ড বাংলাদেশে প্রথম ধ্রুপদের চর্চা শুরু করেন।‌ অখন্ড বাংলার প্রথম ধ্রুপদ গান রচয়িতা হিসেবে তিনি বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বহু খেয়াল গানেরও রচয়িতা। সংস্কৃত ভাষায় বহু ধ্রুপদ রচনা ছাড়াও হিন্দুস্হানী সঙ্গীতের আদলে অসংখ্য বাংলা ধ্রুপদ ও বাংলা খেয়াল রচনা করেন। ছাপাখানার প্রচলন হয়নি তখন। সংরক্ষনের অভাবে তাঁর বিপুল সংখ্যক রচনার বেশীরভাগই বর্তমানে বিলুপ্ত ([xi] দীর্ঘ সাত দশক ধরে, বাংলার সঙ্গীতজগতে তাঁর এই প্রচেষ্টা শিষ্য-প্রশিষ্যক্রমে কলকাতাসহ সমগ্র বাংলার সঙ্গীত জগতকে প্রভাবিত করে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সঙ্গীতের এই ধারা বিষ্ণুপুর ঘরানা নামে গৌরবের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল সঙ্গীতসম্ভার অনেকাংশে বিষ্ণুপুর ঘরানার অনুবর্তী। যদুভট্টের হিন্দি ধ্রুপদ গানগুলির অনুকরণে তিনি বাংলায় ধ্রুপদ গান রচনা করতে থাকেন যদুভট্ট খান্ডার বাণী ধ্রুপদের প্রতি বেশী অনুরক্ত ছিলেন তাই স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথও ছাঁচ হিসেবে খান্ডার বাণীর ধ্রুপদগুলিকেই অনুকরণ করেছেন বেশী শুধুমাত্র যদুভট্ট রচিত গান নয় যদুভট্টের মুখনিঃসৃত বহু প্রাচীন ধ্রুপদ গান থেকেও রবীন্দ্রনাথ গান রচনার প্রেরণা পান সামগ্রিকভাবেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বর, বাণী ও উচ্চারণে ধ্রুপদরীতির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

কিছু ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্র সঙ্গীত ও তাদের উৎস, যদুভট্টের মূল গানের নমুনা:       

                

রবীন্দ্র সঙ্গীত

উৎস, যদুভট্টের মূল গান

রাগ,তাল

শূন্য হাতে ফিরি হে

রুমঝুম বরখে আজু বদরবা

কাফী,সুরফাঁকতাল

জয় তব বিচিত্র আনন্দ

জয় প্রবল বেগবতী সুরেশ্বরী

বৃন্দবনী সারং,তেওড়া

আজি বহিছে বসন্ত পবন

আজু বহত সুগন্ধ পবন

বাহার,তেওড়া

আজি মম মন চাহে

ফুলিবন ঘন মোর আয়ে বসন্তরি

বাহার,চৌতাল

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার রাধিকা প্রসাদ গোস্বামীরও প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে রবীন্দ্রনাথের গানে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, '... রাধিকা গোস্বামীর কেবল যে গানের সংগ্রহ ও রাগ-রাগিণীর রূপজ্ঞান ছিল তা নয়,তিনি গানের মধ্যে বিশেষ একটি রস সঞ্চার করতে পারতেন সেটা ছিল ওস্তাদের চেয়ে কিছু বেশী। সেটা যদি নাও থাকতো তবু তাঁকে আমরা ওস্তাদ বলেই গণ্য করতুম,এবং ওস্তাদের কাছ থেকে যেটা আদায় করবার তা আমরা আদায় করতুম –আমরা আদায় করেওছিলুম সেসব কথা সকলের জানা নেই।'|[xii]

ধ্রুপদের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সঙ্গীতের মহত্ব উপলব্ধি করেন। বাংলা ধ্রুপদের ছায়ায় তিনি নিত্য নতুন রচনা করতে থাকলেন ব্রাহ্মসমাজের জন্য ব্রহ্মসঙ্গীতসারা ঊনবিংশ ও বিংশ শতক যদুভট্ট, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রমুখ আচার্যদের হাত ধরে তৈরী হয় ব্রহ্মসঙ্গীতের রূপরেখা। (Fig. 8) ব্রাহ্মসমাজের বাৎসরিক মাঘোৎসব উপলক্ষে হিন্দুস্থানি ধ্রুপদ ভেঙে রবীন্দ্রনাথ বহু উপাসনা-সঙ্গীত রচনা করেন ব্রহ্মসঙ্গীত চর্চায় অগ্রজদের প্রয়াসের সার্থক পরিণতি ঘটে রবীন্দ্রনাথেরই হাতে ধ্রুপদের আদলে, কবিতা, ভাব ও সুরের সমন্বয়ে তৈরী করতে থাকেন সাধারণ মানুষের সহজপাচ্য পূজা পর্যায়ের অজস্র অসাধারণ সব গানগুলি উপনিষদ, বৈদিক সাহিত্য সেঁচে তুলে আনা কাব্য ধ্রুপদের আঙ্গিকে পরীক্ষা নিরীক্ষায় নতুন নতুন রূপ পেতে লাগলো

 

Fig.8.গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাখোয়াজ। কার্টিসি: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

 

রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সঙ্গীত জীবনের কাজ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর রচিত সঙ্গীতের সংখ্যা ২২৩২ ভিন্নমতে ১৯১৫এই রচনাসম্ভারের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জুড়ে আছে ব্রহ্মসঙ্গীত, যার সিংহভাগই ধ্রুপদাঙ্গের ব্রহ্মসঙ্গীতগুলি পরে পূজা পর্যায়ে(৬১৭ টি গান)স্হান পায় তাঁর ধ্রুপদাঙ্গের গানগুলিতে বিষ্ণুপুরী ধ্রুপদের মতো স্হায়ী,অন্তরা,সঞ্চারী,আভোগ এই চারটি তুক বা কলির সমাবেশ দেখা যায় তালের ক্ষেত্রেও ধ্রুপদে ব্যবহৃত তালগুলিকে হুবহু অনুসরণ করেছেন ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্র সংগীতে পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গে সঙ্গত করা হয়

ধ্রুপদের ছায়ায় বাংলা গানের পাশাপাশি বাংলা রাগাশ্রয়ী গান চর্চার জমিও তৈরী হতে থাকে। বিংশ শতকে জ্ঞানেন্দ্র প্রকাশ গোস্বামীর কন্ঠে গ্রামাফোন রেকর্ডের মাধ্যমে বাঙালী প্রথম রাগসঙ্গীতের স্বাদ পায়।

বাংলা ভাষায় শতাধিক খেয়াল রচনা করে মাতৃভাষায় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চার পথ প্রশস্ত করেন, বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতাচার্য্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়বাংলা খেয়ালের বহু মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন তিনি। আকাশবানীর প্রভাতী অনুষ্ঠানে তিনি মাতৃভাষায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৬২ সালে হঠাৎই আকাশবানী কর্তৃপক্ষ থেকে বার্তা আসে হিন্দী খেয়াল না গাইলে কন্ট্র্যাক্ট বাতিল করা হবে। তিনি রাজি না হওয়ায় তাঁর বাংলা খেয়ালের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে বিস্তর জলঘোলার পর ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রপতি ও বেতারমন্ত্রীর তরফ থেকে বাংলা খেয়াল অনুষ্ঠানের পক্ষে সম্মতি মেলে। কিন্তু এতো স্বত্ত্বেও আকাশবানী কর্তৃপক্ষ তাঁদের অবস্হানেই অনড় থাকেন। দীর্ঘ সময় ধরে আকাশবানী কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছুক অভিপ্রায়কে শানিত যুক্তির সাহায্যে পরাস্ত করে তিনি বাংলা ভাষায় খেয়াল গাওয়ার অধিকারকে অর্জন করেছেন। বাংলা খেয়ালের জগতে তাঁর অবদান চিরস্হায়ী প্রভাব রেখেছে। সম্প্রতি বাংলা খেয়াল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নিরীক্ষামূলক কাজ করে চলেছেন বিশিষ্ট সঙ্গীতগুনী কবীর সুমন।

 

বিষ্ণুপুর ঘরানার বর্তমানকাল

প্রতিবছর বিষ্ণুপুর শহরে অনুষ্ঠিত হয়, ‘সুরযজ্ঞ’ - শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের, চব্বিশ ঘন্টা ব্যাপী, নিরবিচ্ছিন্ন একটি অনুষ্ঠান। ১৯৮৮ সালে এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেন সঙ্গীতাচার্য্য অমরনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘সুরযজ্ঞে’র ত্রিশ বছর পূর্ণ হবে আগামী ২০১৯ সালেবর্তমানে সুরযজ্ঞে অংশগ্রহনকারী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর সংখ্যা আড়াইশোরও বেশী।

এছাড়াও উদযাপিত হয় দুইদিনব্যাপী ‘ধ্রুপদ উৎসব’দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধ্রুপদ শিল্পীরা আসেন। অনুষ্ঠিত হয় ধ্রুপদের বাৎসরিক কর্মশালা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ধ্রুপদের কর্মশালায় অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা ছিল দুইশতাধিক প্রতি বছর ২৭ থেকে ৩১শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ‘বিষ্ণুপুর উৎসব’ বিষ্ণুপুর ঘরানা উদযাপিত হয় এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

এই ঘরানার বর্তমান ধারক ও বাহক সঙ্গীতজ্ঞরা হলেন – অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনিলাল নাগ(সেতার), দেবব্রত সিংহ ঠাকুর, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজিত গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল কবিরাজ(এস্রাজ), জগন্নাথ দাশগুপ্ত, সেবক চট্টোপাধ্যায়, শিব প্রসাদ গোস্বামী(পাখোয়াজ), বামাপদ চক্রবর্তী প্রমুখ। দূর-দূরান্ত থেকে বহু ছাত্রছাত্রী এঁনাদের কাছে এসে বিষ্ণুপুর ঘরানা শিক্ষা করেন।

বিষ্ণুপুরে অবস্হিত রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে বিষ্ণুপুর ঘরানার কন্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত শিক্ষা দেওয়া হয়। ছয় বছরের শিক্ষাক্রম। বিদ্যালয়ের চার বছর এবং মহাবিদ্যালয়ের দুই বছর। শিক্ষান্তে, শিক্ষার্থীদের ‘সঙ্গীততীর্থ’ উপাধি প্রদান করা হয়।

 

 


[i] দাশগুপ্ত, চিত্তরঞ্জনবিষ্ণুপুরের গান প্রত্ন পরিক্রমা : মল্লভূম(), সম্পাদক জলধর হালদার, ৩৯ সেন্টার ফর আর্কিওলজিকাল স্টাডিস এন্ড ট্রেনিং, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ২০১৬

[ii]  রায়, বসন্তরঞ্জন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: ভূমিকা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৯১৬

[iii] সাহা, প্রভাত কুমার শ্রীনিবাস আচার্য: ফিরে দেখা প্রত্ন পরিক্রমা : মল্লভূম(), সম্পাদক জলধর হালদার, ২৩ সেন্টার ফর আর্কিওলজিকাল স্টাডিস এন্ড ট্রেনিং, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ২০১৬

[iv] দাশগুপ্ত, চিত্তরঞ্জন বিষ্ণুপুরের সঙ্গীত সুরযজ্ঞের পঁচিশ বছর পূর্তি সুরযজ্ঞ স্মারক গ্রন্হ : রজত জয়ন্তী বর্ষ, সম্পাদক শ্রী অচিন্ত্য মন্ডল, ২০১৪

[v] মুখোপাধ্যায়, লীলাময় সুরতীর্থ বিষ্ণুপুরের পাঁচ সঙ্গীতগুনী বাংলার আভাষ, ২০০৭

[vi] প্রজ্ঞানানন্দ, স্বামী ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা আনন্দধারা প্রকাশন১৯৬৫  

[vii] ঠাকুর,রবীন্দ্রনাথ সংগীতচিন্তা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১০

[viii] মুখোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার বিষ্ণুপুর  ঘরানা বুকল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬৩

[ix] শংকর, রবি আমার সঙ্গীত আমার জীবন মন্ডল প্রকাশন ২০০৮

[x] মুখোপাধ্যায়, লীলাময় সুরতীর্থ বিষ্ণুপুরের পাঁচ সঙ্গীতগুনী বাংলার আভাষ, ২০০৭

[xi] মুখোপাধ্যায়, লীলাময় সুরতীর্থ বিষ্ণুপুরের পাঁচ সঙ্গীতগুনী বাংলার আভাষ, ২০০৭

[xii] ঠাকুর,রবীন্দ্রনাথ সংগীতচিন্তা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১০

 

গ্রন্থপঞ্জী

বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় কুমার বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি  পূর্ত বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৭১ 

চৌধুরী, রথীন্দ্রমোহন বাঁকুড়াজনের ইতিহাস-সংস্কৃতি  স্বপ্রকাশিত, ২০০০

দাশগুপ্ত, চিত্তরঞ্জন বিষ্ণুপুরের সঙ্গীত সুরযজ্ঞের পঁচিশ বছর পূর্তি সুরযজ্ঞ স্মারক গ্রন্হ : রজত জয়ন্তী বর্ষ, সম্পাদক শ্রী অচিন্ত্য মন্ডল, ২০১৪

দাশগুপ্ত, চিত্তরঞ্জন বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা টেরাকোটা, ২০১৫

দাশগুপ্ত, চিত্তরঞ্জনবিষ্ণুপুরের গান প্রত্ন পরিক্রমা : মল্লভূম(), সম্পাদক জলধর হালদার, ৩৯ সেন্টার ফর আর্কিওলজিকাল স্টাডিস এন্ড ট্রেনিং, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ২০১৬

দে, গৌতম, সম্পাদিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ শতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি  পশ্চিম রাঢ় ইতিহাস সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, ২০০৫

ঘোষ, বিনয় পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি  প্রকাশ ভবন, ২০১৪

গোস্বামী, করুণাময় সংগীতকোষ বাংলা অ্যাকাডেমি, ২০০৮

গোস্বামী, উৎপলা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎপত্তি ক্রমবিকাশ দীপায়ন, ১৪০৫

মুখোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার বিষ্ণুপুর  ঘরানা বুকল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬৩

মুখোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার সংগীত স্মৃতি প্রবাসী, বৈশাখী ১৯৬৮

মুখোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার বাঙালীর রাগ-সঙ্গীত চর্চা কলকাতা ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৭৬

মুখোপাধ্যায়, লীলাময় সুরতীর্থ বিষ্ণুপুরের পাঁচ সঙ্গীতগুনী বাংলার আভাষ, ২০০৭

মুখোপাধ্যায়, লীলাময় সুরতীর্থ বিষ্ণুপুরের দশ সঙ্গীতগুনী  বাংলার আভাষ, ২০০৯

প্রজ্ঞানানন্দ, স্বামী ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা আনন্দধারা প্রকাশন,১৯৬৫|

রায়, বসন্তরঞ্জন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: ভূমিকা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৯১৬

রায়চৌধুরী, বিমলাকান্ত ভারতীয় সঙ্গীতকোষ কথাশিল্প প্রকাশ, বৈশাখ, ১৩৭২

সাহা, প্রভাত কুমার শ্রীনিবাস আচার্য: ফিরে দেখা প্রত্ন পরিক্রমা : মল্লভূম(), সম্পাদক জলধর হালদার, ২৩ সেন্টার ফর আর্কিওলজিকাল স্টাডিস এন্ড ট্রেনিং, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ২০১৬

স্যান্যাল, অমিয়নাথ স্মৃতির অতলে  আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৮

সিংহ, মানিকলাল পশ্চিম রাঢ় তথা বাঁকুড়ার সংস্কৃতি  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৩৮৪

শংকর, রবি আমার সঙ্গীত আমার জীবন মন্ডল প্রকাশন,২০০৮|

ঠাকুর,রবীন্দ্রনাথ সংগীতচিন্তা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১০

ঋণস্বীকার: আচার্য যোগেশ চন্দ্র পুরাকৃতি ভবন, বিষ্ণুপুর (জেলা সংগ্রহশালা)