Bangladesher Jaarigaan

in Article
Published on: 06 October 2017

Dr Saymon Zakaria

Saymon Zakaria is a visiting scholar at the University of Chicago. As a folklore researcher digging through the customs and traditions of Bangladesh for more than 20 years, Zakaria has introduced a distinct way of engaging with indigenous communities for research in ethnographic contexts in the areas of evolving culture and theatrical performances, which have never been explored before to this extent. He is the assistant director of the folklore department at Bangla Academy.

 

‘জারি’ শব্দের অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। শব্দটির উৎস-মূল ফারসি ভাষা। বাংলায় এসে এর অর্থ ব্যাপকতা লাভ করেছে। বাংলাদেশে আরবি মহররম মাসে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে যে কৃত্যমূলক নৃত্যগীত পরিবেশিত হয় তাকেই সাধারণত ‘জারি’ বা ‘জারিগান’ বলা হয়। তবে, অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বা আসরে জারিগানের ধারায় কোনো কোনো ধর্মীয় কাহিনী বা ধর্মীয় ব্যক্তির ত্যাগ, প্রণয়কাহিনী এবং অতি লৌকিক ঘটনা বা সামাজিক বিষয় উপস্থাপিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে জারিগান পরিবেশনায় নানা ধরনের লোকসংগীতের সংমিশ্রণ ঘটেছে; তাই কোথাও আবার কবিগানকেও ‘জারিগান’ বলা হয়। অনুমান করা যায়, দক্ষিণবঙ্গের কবিয়ালেরা জারিগানের বয়াতিদের সঙ্গে কবিগানের আসর করতেন বলেই হয়তো ‘কবিগান’ ও ‘জারিগান’ নাম দুটি পরিপূরক হয়ে উঠেছে। জানা যায়, কবিয়াল বিজয় সরকার তাঁর সমসাময়িক কালের জারিগানের বয়াতি মোসলেম উদ্দিনের সাথে কবিগান পরিবেশন করতেন। যাই হোক, কারবালার শোকাবহ ঘটনা-ই জারিগানের প্রধান উপজীব্য।

 

জারিগানের উদ্ভব : বাংলায় জারিগান পরিবেশনার উদ্ভবসূত্র আবিষ্কার করা যায় আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের বৈঠকি-রীতির ‘জঙ্গনামা’ পরিবেশনায়। গবেষকদের ধারণা ‘জঙ্গনামা’ বৈঠকি-রীতির পরিবেশনা থেকে বিবর্তনের পথ ধরে অবশেষে ‘জারিগান’ (শোকসঙ্গীত) নামে বাংলাদেশের স্থানীয় জনসমাজে প্রভূত খ্যাতিলাভ করে। বাংলাদেশে জারিগানের করুণ কাহিনীতে কারবালায় সংঘটিত যে মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘুরেফিরে আসে তা হলো, কারবালার ফোরাত নদীর তীরে পিপাসার্ত ইমাম হোসেন যখন হাতের অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে মুখে দিতে গেলেন তখন তাঁর স্বজন-প্রতিবেশীদের কথা মনে পড়ল; মনে পড়ল দুধের শিশু আসগরকে তিনি পানি খাওয়াতে ফোরাত নদীর তীরে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শত্রুর একটি তীক্ষ তীর এসে কমলকলি শিশুর জীবনাবসান করল। তারই মতো শত শত শিশু আজ পানি পানি করে শিবিরে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করছে। এই পানি উদ্ধারের জন্য তাঁর সহকর্মীরা কারবালা প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। এসব কথা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম হোসেন তাঁর অঞ্জলি-ভরা পানি ফোরাত নদীতে ফেলে দিলেন এবং নিজেকে শত্রুর হাতে সমর্পণ করলেন। উল্লেখ্য, এই করুণ কাহিনীটি যখন এদেশের গ্রামাঞ্চলে জারিগানের সুরে বর্ণিত হয় তখন শ্রোতৃসাধারণের মন এক মর্মস্পর্শী বেদনার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। স্বজাতির দুঃখে আত্মত্যাগের এই অপূর্ব আদর্শকে বাংলাদেশের মানুষ বড়ই ভালোবাসে। যদিও কারবালা যুদ্ধে শহীদ ইমাম হোসেনের কাহিনীই বর্তমানে মহরমের বিষয়বস্তু। কিন্তু ইসলাম পূর্ববর্তী যুগেও মহরমের পর্ব উদ্যাপিত হতো। এ সম্পর্কে কবি জসীমউদ্দীন উল্লেখ করেছেন- “মর্হরমের দশম তারিখে আশুরা উৎসব পূর্বেকার আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। রসুলুল্লাহ্ বলিতেন, তোমরা এইদিনে ভালো কাজ করো; কারণ এই আশীর্বাদ-পূত মহান দিবসে হজরত আদম আলায়হিস্সালামের প্রতি খোদার দয়া বর্ষিত হইয়াছিল”। ঐতিহাসিক আল্-বেরুনি বলেন, “হোসেনের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানেরা এই দিবসে আনন্দ-উৎসব উদ্যাপন করিত।” কারবালা প্রান্তরে ইমাম হাসান-হোসেনের মৃত্যুর পরে সারা পৃথিবীতে মহরম পালিত হতে থাকে শোক-উৎসব হিসেবে। মহরমের শোক-উৎসবের প্রবর্তন সম্পর্কে জানা যায়, ইমাম হোসেনের শহীদ হবার বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে মহরমের ১০ তারিখে প্রথম শোক-তাপ প্রকাশ করা হয় হিজরি ৩৫২ সালে বাগদাদে মইজুদ্দৌলার রাজত্বকালে। সে সময় অসংখ্য লোক দলেদলে কারবালায় তীর্থ করতে গমন করে। বাংলাদেশে মহরম মাসে কারবালা যুদ্ধের স্মরণে শোক-উৎসব শুরু হয় অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে। কারবালার কাহিনী নিয়ে জারিগানের প্রচলন হয় সপ্তদশ শতকের দিকে।

 

জারিগানের আখ্যানবস্তু কারবালার করুণকাহিনী : ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে ইসলামের সর্বশেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসান-হোসেনের শহীদ হবার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়েই সাধারণত ইসলামের ইতিহাস-নির্ভর জারিগানের আখ্যান পরিবেশন করা হয়। এ ধরনের আখ্যানে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর প্রিয় কন্যা ফাতেমা, জামাতা হজরত আলী ও প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসান-হোসেন প্রসঙ্গে সমকালীন ইতিহাসের অপরাপর চরিত্রের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে গান-কথা-নৃত্য ইত্যাদির আশ্রয়ে বর্ণিত এবং অভিনীত হয়।

ইসলামের ইতিহাস-নির্ভর আখ্যানের উপস্থাপনাশিল্প হিসেবে জারিগানকে অনেকে নাট্যমূলক পরিবেশনা বা জনপ্রিয় ও হৃদয়গ্রাহী ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জারিগানের বহু ধরনের পরিবেশনা-রীতি প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে, কারবালার মর্মান্তিক কাহিনী অবলম্বনে জারিগান পরিবেশিত হয়ে থাকলেও এর আখ্যানবস্তুতে ইমাম হাসান-হোসেন, মাবিয়া-এজিদ প্রভৃতি চরিত্রের পারিবারিক ও সাংসারিক জীবন এ ধরনের পরিবেশনারীতিতে বেশ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। স্থানীয় জারিয়াল-বয়াতি-খেলোয়াড়গণ সাধারণত মীর মশাররফ হোসেন রচিত অমর আখ্যানকাব্য বিষাদসিন্ধু অবলম্বনে পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী প্রভৃতি ছন্দে জারিগান পরিবেশন করে থাকেন।

জারিগানের নাট্যমূলক পরিবেশনার কাহিনীতে জানা যায়-

দামেস্ক রাজ্যের এক সাধারণ প্রজা জব্বারের স্ত্রী জয়নব জল আনতে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল। এজিদ শিকারে গিয়ে জয়নবের দেখা পেয়ে তার রূপে মুগ্ধ হয়। শিকারের সঙ্গী মারোয়ানকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন- ‘কে এই সুন্দরী?’

মারোয়ান এজিদকে জানান- ‘সে রাজ্যের সাধারণ প্রজা জব্বারের স্ত্রী জয়নব।’ এরপর থেকে এজিদ জয়নবকে পাবার চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে এবং অন্যদিকে জয়নব তিলে তিলে মৃত্যুর কথা ভাবে। একসময় এজিদ তার পিতা দামেস্কাধিপতি মাবিয়াকে কথার ইশারায় একথা জানিয়ে দেয়। আর সে ইশারা নিয়ে মাবিয়া অনুসন্ধান করে মন্ত্রী মারোয়ানের কাছ থেকে জানতে পারে এজিদ জব্বারের স্ত্রী জয়নবের প্রেমে পড়েছে এবং সে তাকে ছাড়া বাঁচবে না। কিন্তু মাবিয়া ভেবে পায় না যে, সে কি করবে? কেননা, ধর্মে আছে পরের স্ত্রীর দিকে একবার কুনজরে তাকালে জাহান্নামে যেতে হবে। অথচ, তারই ঔরসজাত ছেলে কি-না পরের স্ত্রীকে আপনার করে চায়। একথা ভেবে মাবিয়া নিজেকেই ধিক্কার দিতে থাকে।

এদিকে মন্ত্রী মারোয়ান মাবিয়াকে বোঝাতে থাকে, যাতে ধর্ম রক্ষা হয় আবার আপনার পুত্রও প্রাণে বাঁচে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মাবিয়া একথায় সম্মতি প্রকাশ করতেই মারোয়ান কৌশলে পত্র লিখে জব্বারকে রাজদরবারে ডেকে পাঠায়।

জয়নব ও জব্বার যখন ঘরে বসে সংসার-সুখের আলাপ করছে তখন তাদের বাড়ির দুয়ারে গিয়ে পত্রবাহক পৌঁছায় এবং জব্বারকে এজিদের পত্র প্রদান করে। এজিদের পত্র পড়ে জব্বার স্ত্রী জয়নবকে জানায়, এখনি তাকে রাজদরবারে যেতে হবে। কেননা, বাদশা এজিদ পত্র পাঠিয়ে তাকে দ্রুত রাজদরবারে ডেকেছে।

কিন্তু স্ত্রী জয়নব কিছুতেই তাকে রাজদরবারে যেতে দিতে চায় না। সে সন্দেহ করে এজিদ তাকে আটকে রাখবে। কিন্তু জব্বার জয়নবের কোনো কথা শোনে না, দ্রুত রাজদরবারের উদ্দেশে যাত্রা করে।

অন্যদিকে রাজদরবারে তখন উজির হাসান এসে বাদশা মাবিয়াকে বলে, জনাব, মারোয়ানকে এতো বড় দায়িত্ব দেওয়া আপনার ঠিক হয়নি। আমার মন বলছে মারোয়ান আপনার মান-সম্মান সব ধূলিশয্যা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। একথা শুনে মাবিয়া উজির হাসানকে বলে, মারোয়ানকে বাধা দিতে এবং পুত্র এজিদকে বোঝাতে।

এরমধ্যে মারোয়ান ও এজিদের পাতা ফাঁদে পড়ে জব্বার রাজদরবারে আসে। মারোয়ান তাকে কাছে পেয়ে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকে এবং একপর্যায়ে এজিদের বোন সালেহার সঙ্গে জব্বারের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। জব্বার তাতে রাজি হলে সে জব্বারকে বলে, সালেহা আপনার সাথে বিয়ে করবে কিন্তু তার আগে আপনার ঘরের স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। জব্বার তাতেও রাজি হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে এজিদ ও মারোয়ান আগে থেকে তৈরি করে রাখা তালাকনামায় জব্বারের স্বাক্ষর নেয়। এবার এজিদ জব্বারের স্বাক্ষর-করা তালাকনামাটি হাতে নিয়ে ঘরে বোন সালেহার কাছে দিতে যায় এবং একটি পত্র হাতে ফিরে এসে মারোয়ানকে বলে ‘মারোয়ান, আমার বোন সালেহা সন্তুষ্ট হয়ে আব্দুল জব্বারকে এই পত্রখানা পাঠ করে শোনাতে বলেছে’। সঙ্গে সঙ্গে মারোয়ান সে পত্র হাতে নিয়ে পাঠ করে শোনায়, যাতে লেখা থাকে,  ‘যে রাজ্যের লোভে নিজের স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে সে কোনোদিন আমার স্বামী হতে পারে না। অর্থের লোভে সে আমাকেও দু’দিন পরে তালাক দিতে পারে। তাই অর্থলোভী জব্বারকে আমি ঘৃণা করি।’ এমন কথা জেনে জব্বার পাগল হয়ে রাজদরবার থেকে বেরিয়ে যায়।

এজিদ ও মারোয়ান এবার মোসলেমকে দিয়ে জয়নবের কাছে পত্র পাঠায়। কিন্তু পত্র নিয়ে যাবার পথে মোসলেমকে আক্কাস, এমনকি ইমাম হাসান জয়নবের বিধবা হবার কথা শুনে তাকে বিবাহ করার অভিপ্রায় জানায়। মোসলেম জয়নবের নিকটে গিয়ে প্রথমে এজিদের প্রস্তাব জানালে জয়নব তা প্রত্যাখ্যান করে। সে ইমাম হাসানের প্রস্তাব গ্রহণ করে।

মোসলেম রাজদরবারে ফিরে এলে এজিদ অস্থির হয়ে ওঠে জয়নবের মতামত জানার জন্য। মোসলেম জানায়, জয়নব তার পত্রে পদাঘাত করেছে। একথা শুনে এজিদ মারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে জয়নবকে জোর করে ধরে আনার জন্য রওনা দেয়।

এদিকে মাবিয়া খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে ইমাম হাসান-হোসেনকে সিংহাসনে বসানোর জন্য গোপনে মদিনায় পত্র প্রেরণ করে। পত্র নিয়ে মোসলেম দ্রুত পৌঁছে দেবার কথা ভাবে। কিন্তু এজিদের কাছে ধরা পড়ে যায়। সে মোসলেমকে ধরে আর মারোয়ানকে তার প্রতিজ্ঞার কথা জানায় যে, তাকে ভিখেরি করে তার পিতা হাসান-হোসেনকে সিংহাসনে বসাতে চায়। কিন্তু এ অসম্ভব! এজিদ যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন দামেস্কের অধিপতি হয়ে বেঁচে থাকবে। এমনই প্রতিজ্ঞা উচ্চারণের মধ্যে প্রহরি এসে সংবাদ দেয়, এজিদের বাবা মাবিয়া মারা গেছে। এজিদ এতে দুঃখ পাবার বদলে খুশিই হয়, কেননা তার চলার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।

এবারে ইমাম হাসানের ঘরে স্ত্রী জায়েদার দুঃখের কথা জানা যাক।

জয়নবকে বিবাহ করার পর ইমাম হাসান স্ত্রী জায়েদাকে আর আগের মতো সময় দেন না। এই দুঃখের কথা জায়েদা কুটনিবুড়ি ময়মুনার কাছে খুলে বলে। ময়মুনা এর উপায় বাতলে দেবে বলে আশা দিয়ে জায়েদার কাছ থেকে সেদিনের মতো বিদায় নেয়।

এদিকে আব্দুল জব্বার ফকিরের বেশে এসে হাসানকে সতর্ক করে দিয়ে যায় যে, এজিদকে উপেক্ষা করে জয়নব তাঁকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেছে বলে এজিদ তাঁর বংশ নিপাত করার জন্য এগিয়ে আসছে। এর ঠিক পর এজিদ হাসান-হোসেনকে পত্র পাঠিয়ে জানায়, পিতার মৃত্যু হয়েছে, সে এখন সম্রাট। রাজার আদেশে এলাকার সকল প্রজা কর পরিশোধ করলেও হাসান-হোসেন এখনপর্যন্ত কর পরিশোধ করেনি। তাই অতিশীঘ্র সমুদয় কর পরিশোধের তাগাদা দেওয়া হলো। এইপত্র পাবার পর হাসান-হোসেন আক্রোশে ফেটে পড়ে। এজিদকে তাঁরা উচিৎ শিক্ষা দেবে বলে ভাবতে থাকে।

এজিদ পত্র প্রেরণ করার পর থেকে হাসান-হোসেনের জবাবের জন্য অপেক্ষা শেষে জানতে পারে হাসান-হোসেন তাকে কর দেওয়া পড়ে থাক, তার পাঠানো পত্রে পদাঘাত করেছে। একথা শোনামাত্র এজিদ হাসান-হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মদিনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। হাসান-পুত্র কাসেম এসে জানায়, এজিদের সৈন্যরা মদিনায় শিবির স্থাপন করেছে। একথা শুনে ইমাম হাসান মদিনাবাসীদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার কথা বলেন। খুব কম সময়ের মধ্যে হাসান-হোসেনের সঙ্গে এজিদ বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়।

কাশেম ও হাসান-হোসেনের যুদ্ধের কৌশলে এজিদ বাহিনীর সেনাপতি মারোয়ান পরাস্ত হয়ে পালায়ন করে। কিন্তু সে এবার নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হাসানকে হত্যা করার জন্য কুটনিবুড়ি ময়মুনাকে নিয়োগ করে।

ময়মুনা জায়েদার কাছে গিয়ে তার দুঃখে সমবেদনা প্রকাশ করে জানায়, সে একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে, যা করলে ইমাম হাসান জয়নবের পরিবর্তে তাকেই বেশি ভালোবাসবে। উপায়টা হচ্ছে- ইমাম হাসান যুদ্ধ প্রান্তর থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে জল খেতে চাইলে তাঁকে শরবত খাওয়াতে হবে, আর শরবতের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হবে সামান্য এক পদার্থ। এই বলে ময়মুনা জায়েদার হাতে এক টুকরো বিষ তুলে দেয়। জায়েদা তা না বুঝে ইমাম হাসানের শরবতের সাথে মিশিয়ে দেয়। সেটি পান করার সাথে সাথে হাসানের বুকের মাঝে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। একে একে ছুটে আসে ইমাম হোসেন, জয়নব ও হাসনা বানু। মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে ইমাম হাসান ভাই হোসেনকে বলে যান সখিনার সাথে যেন কাশেমকে বিবাহ দেওয়া হয়। এমন কথা শেষ না হতেই হাসানের মৃত্যু হয়।

এদিকে এজিদ ও মারোয়ান নতুন কৌশলে হোসেনকে পরাস্ত করার কথা ভাবে। কিন্তু তারা জানে এটা খুবই কঠিন। তাই মারোয়ান সাধারণ প্রজার বেশে ইমাম হোসেনের কাছ থেকে তাঁর মৃত্যুরহস্য জেনে নেয় যে, তাঁর মৃত্যু কেবল কারবালা প্রান্তরেই হবে।

এজিদ কুফানগরের বাদশা জেয়াদকে প্রলোভন দেখিয়ে পত্র লিখে বলে, সে যদি ইমাম হোসেনকে হত্যা করার জন্য সহযোগিতা করে তাহলে এজিদ তাকে স্বাধীন রাজ্য দান করবে, এছাড়া পুরস্কৃতও করবে। জেয়াদ সে প্রলোভনে রাজি হয়ে পত্র পাঠিয়ে অতিসত্তর ইমাম হোসেনকে সিংহাসন গ্রহণের জন্য তার রাজ্যে আমন্ত্রণ জানায়।

ইমাম হোসেন জেয়াদের আমন্ত্রণ কবুল করে শীঘ্র কুফায় গমনের কথা পত্রবাহক মোসলেমকে জানিয়ে দেন। কিন্তু কাশেম হোসেনকে স্পষ্ট করে বলে, এটা কোনো চক্রান্ত হতে পারে। হোসেন তার কথার প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আরব দেশে যদি তাঁর কোনো বন্ধু থাকে তবে সে জেয়াদ। সে প্রতারণা করতে পারে না।’

হোসেনের স্ত্রী শহরবানু কাশেমের কথার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলে, ‘তবু সবকিছু জেনে নেওয়া ভালো। আমাদের বিপদের শেষ নেই।’ একথার পরে কাশেম নিজেই যেতে চায় খোঁজ-খবর নিতে। কিন্তু হোসেন তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন, ‘অসময়ে তিনি তাকে চোখের আড়াল করতে চান না।’ এ সময় সেখানে মোসলেম এসে বলে, ‘আমাকে আদেশ করুন। আমি যাবো কুফানগরে।’

ইমাম হোসেনের অনুমতি পেয়ে মোসলেম কুফানগরে জেয়াদের দরবারে আসে। কিন্তু মোসলেমের সঠিক সংবাদটি নিয়ে যাওয়া হয় না। সে এজিদের সৈন্য আর জেয়াদের চক্রান্তে শহীদ হয়। ইমাম হোসেন তাঁর সৈন্যবর্গ নিয়ে উপস্থিত হন কারবালা প্রান্তরে। শুরু হয় এজিদ বাহিনীর সাথে হোসেন বাহিনীর মর্মান্তিক যুদ্ধ। যুদ্ধের মধ্যেই হাসানের বলে যাওয়া কথার নির্দেশে সখিনা ও কাশেমের বিবাহ হয়। বাসরশয্যা ছাড়াই বিবাহের পোশাকে কাশেম যুদ্ধের ময়দানে রওনা দেয় এবং মরণপণ যুদ্ধ করতে করতে ফিরে আসে শহীদের বেশে।

সবশেষে ইমাম হোসেন নিজহাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন এজিদের সেরাসৈন্য অলিদ ও মারোয়ানের সঙ্গে। অলিদ ও মারোয়ান উভয়েই হোসেনের কাছে পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যায়।

এবার ইমাম হোসেনের সামনে দাঁড়ায় সীমার। শুরু হয় তাদের যুদ্ধ। সীমারের কাছে হোসেন পরাস্ত হন। সীমার হোসেনের বুকে চেপে বসে। সে সময় হোসেন নামাজ আদায় করার সুযোগ চান। হোসেনের অনুরোধে সীমার তাঁকে নামাজ পড়ার সুযোগ দেয় ঠিকই কিন্তু নামাজ শেষ না হতেই আবার তাঁর বুকে চেপে বসে হত্যা করার জন্য এবং সে হোসেনের বলে দেওয়া কথামতো তাঁর মাথা কেটে নেয়। এরপর হোসেনের কাটা মস্তক নিয়ে সীমার একজন ব্রাহ্মণের বাড়িতে পুটলিতে ভরে রেখে যায় পরের দিন এসে নিয়ে যাবে বলে। সে রাতে উষা-প্রদীপ এসে ব্রাহ্মণের কাছে ক্ষুধার কথা বলে খাবার চায়। ব্রাহ্মণ সীমারের রেখে যাওয়া পুটলির ভেতর খাবার আছে ভেবে তাকে তা খুলে খেতে বলে। উষা-প্রদীপ পুটলি খুলে বলে, ‘একি বাবা! এ মস্তক তুমি পেলে কোথায়? এটা কার মস্তক?’ ব্রাহ্মণ তাকিয়ে দেখে হোসেনের মস্তক। ব্রাহ্মণী এসে হোসেনের মস্তক দেখে ব্রাহ্মণকে বলে ‘অর্থের লোভে তুমি হোসেনকে খুন করেছো! আমি বেঁচে থাকতে এই মস্তক কিছুতেই তোমার হাতে দেবো না।’ কিন্তু সকালে তো সীমারকে একটা মাথার পুটলি দিতেই হবে। উষা-প্রদীপ ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীকে বলে, ‘আমাদের মাথা কেটে পুটলিতে ভরে সীমারকে দিও, তবু ওই পাপীর হাতে হোসেনের মাথা দিও না।’ ব্রাহ্মণ নিজের মাথাও হোসেনের মাথার পরিবর্তে সীমারের হাতে দিতে চায়।

শেষপর্যন্ত হোসেনের মাথার পরিবর্তে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী উষা-প্রদীপের মাথার পুটলি সীমারের হাতে তুলে দেয়। সীমার তা না বুঝে এজিদের রাজদরবারের উদ্দেশে রওনা দেয়। এদিকে হোসেনের মাথা রক্ষা করতে পেরে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী ছুটে পালাতে থাকে।

এজিদের দরবারে পৌঁছে সীমার এজিদের সামনে মাথার পুটলিটি রাখে। এজিদ এতে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ‘একি করেছো সীমার! আমি বলেছিলাম তোমাকে হোসেনকে এখানে হাজির করতে। আর তুমি তাঁকে হত্যা করেছো! আমি তোমাকে এর শাস্তি দিলাম মৃত্যুদণ্ড’। সাথে সাথে সীমার কথা পাল্টে বলে, ‘জনাব, দামেস্কের রাস্তায় আমি এক সুন্দরী নারী দেখে এলাম।’

এজিদ মুহূর্তের মধ্যে যেন বদলে যায় এবং বলে, ‘সুন্দরী, সুন্দরী, সুন্দরী নারী! কে সেই সুন্দরী?’ উত্তরে মারোয়ান বলে, ‘জয়নব। সে হলো জয়নব সুন্দরী।’ এজিদের আবার পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়, ‘জয়নব, জয়নব। মারোয়ান, এই জয়নবই আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আমি এখন শুধু জয়নবকেই চাই।’

মারোয়ান এই সুযোগে সীমারের জন্য সুপারিশ করে বলে, 'তাহলে এবারের মতো সীমারকে ক্ষমা করুন।'

এজিদ বলে, ‘এবারের মতো ক্ষমা করছি। কিন্তু সীমার, আমার সামনে তুমি জয়নব, শহরবানু ও জয়নালকে হাজির করবে। এর বিনিময়ে তোমাকে দুই লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করবো।’

সীমার মুহূর্তের মধ্যে ছুটে যায় ইমাম হাসান-হোসেন পরিবারের জীবিত সদস্যদের দিকে এবং তাদেরকে বন্দি করে এজিদের দরবারে নিয়ে আসে। এজিদ মুখোমুখি জয়নবকে পেয়ে পুরোনো প্রস্তাবটি নিজের মুখেই বলে। কিন্তু জয়নব কিছুতেই রাজি হয় না দেখে তাদেরকে অন্ধকার কারাগারে বন্দি করে। কারাগারে বন্দি অবস্থায় জয়নাল শহরবানুর কথামতো আম্বাদ শহরের বীরযোদ্ধা তার চাচা মুহাম্মদ হানিফকে পত্র লেখে। গোপনে কাসেদের হাত দিয়ে পত্রখানা চাচা হানিফের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়।

হানিফ পত্র মারফত সব সংবাদ পেয়ে একদল সৈন্য নিয়ে বাতাসের বেগে ছুটে এসে পরিবারের সকল সদস্যকে উদ্ধার করে এবং ইমাম হোসেনকে হত্যার অপরাধে এজিদকে হত্যা করে।

 

জারিগান পরিবেশনা সম্পর্কিত তথ্য: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবেশিত জারিগানের আসরে সাধারণত উপর্যুক্ত আখ্যানটিই নানাভাবে নৃত্য, গীত ও হাততালি সহযোগে পরিবেশিত হয়ে থাকে।

মূলত জারিগানের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের মধ্যে কারবালার শোকাবহ কাহিনী বিস্তৃতি লাভ করেছে। কারবালার আখ্যাননির্ভর জারিপালার মধ্যে ‘জয়নাল আবেদীনের পত্র’, ‘সখীনার কান্না’, ‘কাশেম শহীদ’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর মধ্যে ‘জয়নাল আবেদীনের পত্র’ পালার কাহিনী থেকে জানা যায়,  এজিদের সঙ্গে যুদ্ধে ইমাম হোসেনের পুত্র জয়নাল আবেদীন পরাজিত হয়ে জেলখানায় বন্দি আছে। এজিদ বন্দি জয়নালের কাছে মারোয়ানকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠায়, ইমাম হোসেন-পুত্র জয়নাল আবেদীন যদি মসজিদে গিয়ে এজিদের নামে খুতবা পড়ে তাহলে সে জয়নালকে ছেড়ে দেবে। এই প্রস্তাবে জয়নাল কেঁদে বলে, ‘আমার আজ এমন কেউ নেই যার কাছে মনের কষ্টের কথা বলতে পারি। যে এজিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমার বাবা-চাচা সবাই শহীদ হয়েছে, আমার মৃত্যু হলেও আমি সে এজিদের নামে খুতবা পড়তে পারবো না।’ কিন্তু এজিদ তাঁকে জোর করে তার নামে খুদবা পড়তে জয়নালকে মসজিদে পাঠায়। জয়নাল খুতবা পড়তে গিয়ে সাহসের সঙ্গে কোরান হাতে নিয়ে নবিজী, দাদা আলী ও বাবা হোসেনের নামে খুতবা পড়ে। এর ফল হয় খুবই ভয়াবহ। কাফেররা সবাই জয়নালকে ঘিরে ফেলে। জয়নাল তা দেখে ভয় পায় কিন্তু ভেঙে পড়ে না বরং একটা পত্র লিখে চাচা মুহাম্মদ হানিফের কাছে গুপ্তচরের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। হানিফ সেই পত্রের ভিত্তিতে জয়নালকে রক্ষা করতে ছুটে আসে।

কারবালার এরূপ আরও অনেক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারায় এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জারিগান, জারিনাচ ও শোভাযাত্রামূলক জারি পরিবেশন করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে কারবালার ইতিহাসের নানা ঘটনাকে অবলম্বন করে ছোট ছোট পর্বে বা পালায় জারিগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে ইমাম হাসান-হোসেনের জারি অধিক জনপ্রিয় হলেও মা ফাতেমার জারি, কাসেম-সখিনার জারি ইত্যাদি জারি-পালাসমূহও কম জনপ্রিয় নয়।

প্রতিবছর মহরমের সময় মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, পাবনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় শোভাযাত্রামূলক জারিগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে দলবদ্ধভাবে একদল দোহার-খেলোয়াড় ঢোল, নাকাড়া, করতাল ইত্যাদি সহযোগে মহরমের চাঁদ দেখা দেবার পর বিভিন্ন গ্রাম প্রদক্ষিণ করে এবং স্থানে স্থানে থেমে থেমে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে আহাজারিমূলক জারি পরিবেশন করে পুনরায় সামনে এগিয়ে যায়। এ ধরনের জারি নৃত্য-গীতের শোভাযাত্রার সঙ্গে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের সাদৃশ্য আছে। এর সঙ্গে কোথাও কোথাও ঘোড়ানাচ যুক্ত হতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও তরবারি যুদ্ধ দেখা যায়। এভাবে বিভিন্ন গ্রাম প্রদক্ষিণের পর মহরমের দশম চাঁদে দলটি নির্ধারিত স্থানে ফিরে এসে চূড়ান্তভাবে নৃত্যগীত প্রদর্শনের মাধ্যমে এক বছরের শোভাযাত্রামূলক জারি সমাপ্ত করে।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি ফোকলোর সংগ্রহমালার একাধিক খন্ডে গত শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশের রংপুর, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, যশোর, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ‘কারবালার জারি’, ‘মহরমের জারি’, ‘মোসলেমের জারি’, ‘জারিগানের মইছরা’, ‘কুলছুম বিবির মেজবানির জারি’, ‘মক্কার জর্মনামা জারি’, জোলানামার জারি’, ‘নূহ নবির জারি’, ‘দর্জালের জারি’, ‘কাসেদনামা জারি’ ইত্যাদি পালা সংকলিত করেছে, সংকলিত জারিপালাসমূহের শুরুতে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমির ফোকলোর আর্কাইভস্ সংরক্ষিত উনিশশত ষাটের দশকে সংগৃহীত জারিগানের পালাসমূহের পরিবেশনারীতির কোনো বিবরণ তেমনভাবে বর্ণিত হয়নি। তবে, একই দশকে বাংলাদেশে প্রচলিত জারিগানের পরিবেশনারীতি সম্পর্কে কবি জসীমউদ্দীনের বর্ণনা থেকে জানা যায়- সে সময়ে ফরিদপুর, যশোর, ঢাকা, বরিশাল, খুলনা ও ময়মনসিংহ জেলায় জারিগানের বহু দলের অস্তিত্ব ছিল। প্রত্যেক দলে আট/দশজন করে দোহার থাকত। তিনি লিখেছেন:

 

জারিগানের দলপতিকে বয়াতী বলে। বয়াতী তার ডান বগলের মধ্যে একটি খঞ্জরি লইয়া বাম হাতের তালু দিয়া আঘাত করিয়া তার ডান হস্তস্থিত টোকার উপর আঙুল পরিচালনা করিয়া এক অপূর্ব তাল-লহরির সৃষ্টি করে। খঞ্জরি কাষ্ঠ-নির্মিত একটি ক্ষুদ্র ঢোলকের মতো। তাহার এক মুখ সানকুনী সাপের চামড়া দিয়া ঘেরা। ন্যাকড়া পেঁচাইয়া একটি বলয়ের মতো করিয়া তাহা খঞ্জরির কাষ্ঠ-পরিধির মুখ-সংলগ্ন সানকুনী সাপের আচ্ছাদনকে খঞ্জরির সঙ্গে আটকাইয়া রাখে। উহা নামাইয়া-উঠাইয়া খঞ্জরির বাদ্যকে উচ্চ-নীচ স্বরগ্রামে উন্নীত করা যায়। খঞ্জরির ছাউনির নিম্নে কাঠের বেড়ের সঙ্গে একজোড়া করতাল আটকানো থাকে। খঞ্জরির ছাউনির উপর বাম হাতের তালু দিয়া টোকা দিতে উহারাও বাজিয়া উঠিয়া খঞ্জরি বাদ্যকে আরও বৈচিত্র্যমুখর করিয়া তোলে। খঞ্জরির কাঠের বেড়টি সাধারণত গ্রাম্য সূত্রধরেরা তৈরি করিয়া দেয়। বয়াতীরা নিজেরাও মাঝে মাঝে খঞ্জরি তৈয়ার করিয়া থাকে। কোন কোন খঞ্জরির কাঠের বেড়ের উপর নিপুণ শিল্পকার্য দেখা যায়। টোকাও একটি কাষ্ঠনির্মিত তলিহীন মাটির মতো। তাহার এক মুখ চামড়া দিয়া আবৃত। তাহাতে টোকা দিয়া খঞ্জরির সঙ্গে তাল রক্ষা করা হয়। ইহা কতকটা তবলার মতো। সুদক্ষ বয়াতীরা খঞ্জরি লইয়া দেশি ঢোল বাদ্যের দুরূহ তালগুলি অতি সুন্দর করিয়া বাজাইতে পারে। আজকাল জারিগানের দলে আগেকার মতো খঞ্জরি বাজানো বড় দেখা যায় না। আধুনিক জারিগানের দলপতিরা ঢোল ও হারমোনিয়ামের সাহায্যে তাহাদের গানের আবহ রচনা করে। বর্তমানে ফটিক বয়াতীর জারিগানের দলে খঞ্জরি বাদ্যের প্রচলন আছে।

 

সাম্প্রতিককালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত জারিগানের পরিবেশনায় সাধারণত ভূমি সমতলে বৃত্তাকার মঞ্চ বা পরিবেশনাস্থান ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের পরিবেশনারীতিতে একজন গায়ক বা বয়াতি সাদা ধুতি বা পায়জামার সাথে সাদা গেঞ্জি পরিধান করেন আর তার সহযোগী গায়েন ও একদল নৃত্যকার-দোহার সাদা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জির সাথে বিশেষ ধরনের পায়জামা ও হাতে রুমাল ব্যবহার করেন। এ ধরনের নৃত্যগীতে অধিকাংশ সময় মূলগায়েন ও তার সহযোগী গায়েনের অবস্থান থাকে বৃত্তাকারে নৃত্যরত কুশীলবদের বৃত্তের বাইরে। তবে সহযোগী গায়েনকে কখনো কখনো বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করতে দেখা যায়। জারিগান পরিবেশনকালে দোহার-নৃত্যকারগণ শুধুমাত্র হাততালি, অঙ্গভঙ্গি ও রুমাল সঞ্চালনের মাধ্যমে জারিগান পরিবেশন করেন। এর পরিবেশনাতে প্রায় সবসময় অসাধারণ নৃত্যকৌশল প্রযুক্ত হয়ে থাকে। জারিতে গানের প্রতি-চরণের সঙ্গে নৃত্যের তাল প্রত্যক্ষ করা যায়। কিশোর ও যুবক নৃত্যকারগণ কখনো কখনো পরস্পর সংবদ্ধ, কোমরে হাত দিয়ে বৃত্ত, রেখা ও সর্পিল গতিভঙ্গ সৃজন করেন। এ শ্রেণীর জারিগান শূন্যে লম্ফদানের কৌশলদীপ্ত পৌরুষের পরিচয়বাহী। গবেষকগণ জারিগানের এ নৃত্যের সঙ্গে মণিপুরী লম্ফনৃত্য বা চৈনিক ব্যালের তুলনা করেছেন। জারিগানে সকল নৃত্যকারী সচরাচর পায়ে নূপুর ব্যবহার করে থাকেন।

 

জারিগান মূলত বর্ণনাত্মক গীতিনৃত্যমূলক পরিবেশনা। আসলে বর্ণনাত্মকগীতির আশ্রয়ে মূলগায়েন কারবালার মর্মান্তিক যুদ্ধের এক একটি আবেগময় ঘটনা আসরে উপস্থাপন করে থাকেন; আর দোহার-নৃত্যকারগণ ধুয়াগীত ও নৃত্য পরিবেশন করে সে আবেগে দৃশ্যকল্প দান করেন। যে কারণে জারিগানের আসর সাধারণ দর্শক-শ্রোতাদের কাছে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

 

জারিগান পরিবেশনার সময় : জারিগান অনুষ্ঠানের প্রধান সময় হচ্ছে মহরম মাস। এই মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জারিগানের আসর অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত মহরমের ১ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় নিয়মিতভাবে জারিগানের আসর হয়। জারিগান পরিবেশনার জন্য দিন-রাতের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। তাই রাত ও দিন উভয় সময়েই জারিগানের আসর চলতে পারে। মহরম ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মেলা, উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও আজকাল জারিগান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

 

জারিগান পরিবেশনার শিল্পী-কুশীলব বর্তমান অবস্থা : জারিগানের দলে আগে যে সকল কুশীলব অভিনয় করতেন এবং বর্তমানে যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের একটি করে নাম আছে। এর শিল্পী-কুশীলবদের মধ্যে প্রধানত নৃত্যকারদেরকে কোথাও খেলোয়াড়, আবার কোথাও জারিয়াল এবং জারিগানের প্রধান গায়ককে প্রায়সব অঞ্চলে বয়াতি বলা হয়। এছাড়া, জারিগানে নাচের দলের পরিচালককে বলা হয় রেফারি। জারিগানের আসরে বৈচিত্র্য আনতে যখন নাচের গতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তখন এই রেফারিই বাঁশি ফুঁকে নাচের গতি পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন।

জারিগানের বর্তমান অবস্থা আগের মতো সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত আকারে না থাকলেও এদেশের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, জয়পুরহাট, নড়াইল, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে জারিগানের ঐতিহ্য এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। প্রতিবছর মহরমের সময় ওইসব অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠী জারিগানের আসর করে শোকের মাতম তুলে ভক্তদের প্রাণ কাঁদিয়ে দেয়।

 

সহায়ক গ্রন্থ

জসীমউদ্দীন, জারীগান, কেন্দ্রীয় বাঙ্লা-উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৬৮

জাকারিয়া, সাইমন. বাংলাদেশের লোকনাটক : বিষয় আঙ্গিক-বৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০০৮

———.প্রণমহি বঙ্গমাতা (দ্বিতীয় পর্ব), মাওলা ব্রাদার্স, বাংলাবাজার, ফেব্রুয়ারি ২০০৬