তরজাগান বাঙালির সঙ্গীতচর্চার একটি বিশেষ ধারা। তরজার পরম্পরীণ ইতিহাস আলোচনায় নানান ব্যাসকূটে মোড়া মহাভারত থেকে শুরু করে সান্ধ্যক্ষরময় চর্যাপদ, শ্রীচৈতন্যদেবের হেঁয়ালি প্রবণতা, প্রহেলিকাপূর্ণ ধর্মের গাজন –প্রভৃতি প্রসঙ্গ যেমন এসে পড়ে তেমনই এসে পড়ে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আখড়াই, ঢপ, হাফ-আখড়াই, পাঁচালি, আর্যা, যাত্রা, কবিগানের প্রাদুর্ভাবের কথা। আর এই সূত্রধরেই আমরা হদিস পাই বৃটিশ ক্ষমতা অধিগ্রহণের অভিঘাতে কলকাতা এবং তার আশপাশের অঞ্চল ঘিরে গড়ে ওঠা বাবু-সংস্কৃতির।
মূলত নাগরিক সংস্কৃতির হাত ধরে উদ্ভব হলেও তরজাগানের মধ্যে লোকরঞ্জনের যে আশ্চর্য ক্ষমতা বোধ করি তার ফলেই কালক্রমে গ্রামীণসমাজের কাছে এই দেশীয়রীতির সঙ্গীত-নাট্যধারাটি সমাদর পেতে শুরু করে।
তরজা হল হেঁয়ালি বা প্রহেলিকাধর্মী ছড়াগান, যা দুজন মূলগায়েন তাঁদের সহকর্মীদের নিয়ে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ছদ্ম-লড়াইয়ের ধাঁচে আসরে পরিবেষণ করে থাকেন। তরজার কোনো মঞ্চে ‘বন্দনা’ পর্ব দিয়ে শুরু করে মাঝে ‘চাপান’ ও ‘উতোর’ পর্ব এবং শেষে ‘মিলন’দিয়ে গায়েনরা আসরের সমাপ্তি ঘোষণা করে থাকেন।
বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, হাওড়া, হুগলী, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলাগুলিতে তরজার প্রচলন লক্ষ করা যায়। এই সকল অঞ্চলগুলিতে কোনো বারোয়ারি মেলা বা পূজা-আর্চা উপলক্ষে তরজাগানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
তরজাগানের বিষয়বস্তু মূলত পৌরাণিক। রামায়ণ, মহাভারত, বেদ-পুরাণের কাহিনি তরজার গায়েনরা নিজেদের জ্ঞান এবং মেধা অনুযায়ী চয়ন করে আনেন এবং তা সংলাপ ও সঙ্গীতের মাধ্যমে আসরে উপস্থাপন করেন। এক সময় মনে করা হত, শাশ্বত কিছু পুরাণকাহিনিকে হেঁয়ালি বা প্রহেলিকার মাধ্যমে আসরে উপস্থাপন করাই তরজা গায়েনদের কাজ। কিন্তু মনে রাখতে হবে পুরাণকাহিনি স্থাণু, অথচ সমাজ প্রতিনিয়িত গতিশীল। এই গতির পথে পা বাড়ানোর জন্য তরজা’র প্রয়োজন ছিল নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করা। তাই দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক নানান উদ্দেশ্যমূলক কাজে তরজাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন নিরক্ষরতা দূরীকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সমাজে মহিলাদের সমনাধিকার দান ইত্যাদি বিষয় নিয়েও তরজাগান পরিবেশিত হচ্ছে। তরজার এই ধাঁচা পরিবর্তন দেখে মনে হয় বিশ্বায়নের বেনোজলে গা ভাসিয়েছে বাংলার তরজাগানও। তবে আশার কথা এই পথে হেঁটেই তরজা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে নিজের ঐতিহ্যকে।